এ জঙ্গলে এটাই ছিল মানুষের প্রথম পদচারণা। হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের জন্য এটা ছিল একটি অভয়ারণ্য। হঠাৎ মানুষের বিশাল এক বাহিনী জঙ্গলে প্রবেশ করার কারণে জম্ভগুলো ভয়ে এদিক-সেদিক চলে যাচ্ছিল। তারপরও কয়েকটি ঘোড়া ও খচ্চর হিংস্র জন্তর আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে গোটা বাহিনীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। কেউ যেন একা একা কোথাও না যায়।
জলাভূমির এই অভিযানে তারিক-বাহিনীর দেড় মাসের মতো সময় লেগে গেল। কিন্তু এখনও জলাভূমি শেষ হওয়ার কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না। অভিযানের এই পর্যায়ে ঐতিহাসিকগণ যে বিবরণ তুলে ধরেছেন, তা নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক ও এ্যাডভ্যাঞ্জারপূর্ণ।
এ পর্যন্ত পৌঁছে মুজাহিদ বাহিনী অত্যন্ত সরু ও অত্যধিক উঁচু একটি রাস্তার সম্মুখীন হন। মুজাহিদ বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের অবস্থা একেবারে শোচনীয় হয়ে গিয়েছিল। এখান থেকে শুরু হয় মুজাহিদ বাহিনীর আরও ভয়ঙ্কর ও লোমহর্ষক এক অভিযান।
সামনে অগ্রসর হওয়ার একটি মাত্র পথই খোলা ছিল। পথটি ছিল অত্যন্ত সরু ও অত্যধিক উঁচু। একটি পাহাড়কে কেন্দ্র করে পথটি উপরের দিকে উঠে গেছে। পথটি যতই উপরের দিকে উঠেছে, ততই অপ্রশস্ত ও সরু হয়ে গেছে। পথের শেষ দিকে একজন মানুষ বা একটি ঘোড়র পক্ষে সামনে অগ্রসর হওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। উপায়ন্তর না দেখে মুজাহিদ বাহিনী সেই পথ ধরে সামনে অগ্রসর হতে শুরু করে।
কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর দুই-তিনটি খচর পা পিছলে চোখের পলকে পাহাড়ের গভীর খাদে পড়ে যায়। খচ্চরগুলোকে কিছুতেই বাঁচানো সম্ভব ছিল না। মুজাহিদ বাহিনী সামনের দিকে এগিয়ে চলল। চলতে চলতে তারা এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছল, যেখানে পাহাড়গুলো এক সাথে মিশে সুউচ্চ এক দেয়ালের রূপ ধারণ করেছে। পিছনের মতো সরু কোন রাস্তার চিহ্নও চার দিকে দেখা যাচ্ছিল না।
মুজাহিদ বাহিনীর গন্তব্য ছিল এই পাহাড়ের শীর্ষচূড়া। গন্তব্যে পৌঁছতে হলে পাহাড়ের এই দেয়াল বেয়ে উপরে উঠা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। এই রাস্তা অবলম্বন করার আগে পূর্ণ একদিন যাত্রা বিরতি দিয়ে রাস্তা খোঁজার জন্য চার দিকে লোকজন পাঠানো হল। কিন্তু চার দিকে উঁচু উঁচু পাহাড়, পাহাড়ের গভীর খাদ, আর পাহাড়ী নদী ছাড়া কোন কিছুই দেখা গেল না। অগত্যা এই পাহাড়ী দেয়ালের খাঁজ বেয়ে উপরে উঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। মুজাহিদগণ দম বন্ধ করে পাহাড়ের খাজে খুঁজে পাও রেখে অগ্রসর হলেন। সামান্য পা পিছলে গেলেই শত শত ফুট গভীর খাদে পতন সুনিশ্চিত। ঘোষণা করে দেওয়া হল, কেউ যেন ডানে-বামে না তাকায়।
রাস্তা খুবই সংকীর্ণ। আর উচ্চতা এত বেশি যে, নিচের দিকে তাকালে ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যেত, মাথা ভন ভন করে ঘুরে উঠত। গোটা বাহিনী সন্তর্পণে পাথরের খাঁজ বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। হঠাৎ দুটি ঘোড়ার পা পাথর থেকে সামান্য সরে গেলে ঘোড়া দুটি ভয় পেয়ে কেঁপে উঠল। পর মুহূর্তেই পাহাড়ের খাদ বেয়ে গড়িয়ে ডিগবাজি খেয়ে আরোহীসহ দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল। তার পর আরও দুই-তিনজন মুজাহিদের পরিণতিও এমনই হল। তাদের চিৎকার আর আর্তনাদের আওয়াজ ধীরে ধীরে বহু দূরে মিলিয়ে গেল। পরক্ষণেই ভয়াবহ এই পাহাড়ী পথে ভুতুড়ে নীরবতা নেমে এলো।
প্রায় সকল ঐতিহাসিকই ভয়ঙ্কর এই রাস্তার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তারা সকলেই লেখেছেন, একমাত্র তারিক বিন যিয়াদের পক্ষেই সম্ভব, এমন ভয়াবহ ও বিপদজ্জনক পথে সেনাবাহিনী পরিচালনা করা। তিনি যদি তার বাহিনীকে এই বিপদজ্জনক পথ অতিক্রম করার নিয়ম-কানুন না বলে দিতেন তাহলে তার বাহিনীর অধিকাংশ সিপাহী আর ঘোড়া আত্মঘাতী হয়ে যেত।
অত্যন্ত সরু আর অস্বাভাবিক উঁচু এই রাস্তা মাত্র দুই দিনে অতিক্রম করা সম্ভব হল। রাতের বেলাও অভিযান অব্যাহত ছিল। এমন স্থানে যাত্রা বিরতি করা আত্মহত্যা করার শামিল। সামান্য সময়ের জন্য যাত্রা বিরতি করলেও ক্লান্তি কারণে ঝিমুনি এসে পড়ত। আর এই ঝিমুনি গোটা বাহিনীকে পাহাড়ের গভীর খাদের দিকে ঠেলে দিত। মুজাহিদগণ পাহাড়ের খাদ বেয়ে গড়িয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হতেন। তাই যাত্রা বিরতি না করে রাতের বেলাও অভিযান অব্যাহত রাখা হল। রাতে পথ চলার জন্য মশাল জ্বালানো হত।
মুজাহিদ বাহিনীর চলার গতি একেবারেই কমে গিয়েছিল। পরদিনও একই গতিতে মুজাহিদ বাহিনী এগিয়ে চলল। মুজাহিদ বাহিনী যতই গ্রসর হচ্ছিল, রাস্তা ততই উঁচু আর সংকীর্ণ হচ্ছিল। মুজাহিদগণের কাছে মনে হচ্ছিল, তারা স্বপ্নে পথ চলছে। তাদের দু’চোখ জোড়ে ছিল ঘুমের আধিক্য, আর সারা শরীর জোড়ে ছিল সফরের ক্লান্তি। তার উপর অজানা বিপদের আশঙ্কা তাদের মন-মানসিকতাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সবচেয়ে বড় কথা হল, দুদিন যাবত মুজাহিদগণ ক্ষুধার্ত ছিলেন। খাওয়ার মতো কোন কিছুই তারা পাননি। গত দুই দিনে ঘোড়া আর খচ্চরগুলোকেও কোন কিছু খাওয়ানো হয়নি। জীব-জন্তুগুলো বেকাবু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। আরোহীদের কৃতিত্ব স্বীকার করতে হয় যে, তারা জগুলোকে আয়ত্বে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছুক্ষণ পূর্ব থেকে রাস্তা ধীরে ধীরে প্রশস্ত হয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করল। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর এই রাস্তা এক পাহাড়ের সাথে মিশে গেছে। সেখান থেকে বাঁক নিয়ে সামান্য অগ্রসর হয়ে রাস্তা এক প্রশস্ত উপত্যকার সাথে একাকার হয়ে গেছে। উপত্যকা এতটাই প্রশস্ত ছিল যে, গোটা মুজাহিদ বাহিনী সহজেই সেখানে অবস্থান করতে পারত।