তারিক বিন যিয়াদের কথাগুলো এতটাই মর্মস্পর্শী আর আন্তরিক ছিল যে, জীবনবাজি রাখা এই অভিযানে প্রত্যেকজন মুজাহিদের চেহারা ছিল আনন্দে উজ্জ্বল আর ঠোঁটে ছিল মুচকিহাসি। তারিক বিন যিয়াদের উদ্দীপনামূলক কথার উত্তরে সকল মুজাহিদ এক সাথে বলছিল :
‘তারিক! আমরা তোমার সাথে আছি।‘
মুহুর্মুহু আল্লাহ আকবার ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী সামনে এগিয়ে চলছিল। তারিক-বাহিনীর এই অভিযানের বিবরণ ইতিহাসের গ্রন্থসমূহে সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অভিযান এতটাই ভয়ঙ্কর ও লোমহর্ষক ছিল যে, এর আদ্যোপান্ত একত্রিত করা হলে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থের রূপ ধারণ করবে। এমন ভয়াবহ অভিযানে গোটা বাহিনী না হলেও প্রায় অর্ধেক বাহিনীর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়া ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে এই লোমহর্ষক অভিযানের দুই-একটি ঘটনা উল্লেখ করা হল।
***
তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী চলতে চলতে এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছল যেখানের মাটি অদ্ভুত রকম ঘাস দ্বারা ঢাকা ছিল। এই এলাকায় কোন গাছ ছিল না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই এলাকার আয়তন দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রায় এক মাইল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, এই এক মাইল এলাকায় শুধুমাত্র ঘাসই ছিল। ঘাসগুলো এক থেকে চার ফিট পর্যন্ত লম্বা ছিল। এলাকাটি বড় বড় গাছ আর উঁচু উঁচু টিলা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। বিভিন্ন প্রকার গাছ-গাছালি টিলাগুলোকে ঢেকে রেখেছিল। রাস্তা তো দূরের কথা পায়ে হাঁটার সরু কোন পথও সেই এলাকায় ছিল না। মুজাহিদ বাহিনী ছয়-সাতটি সারিতে বিন্যস্ত হয়ে পথ চলছিল। প্রত্যেক সারির অগ্রভাগের মুজাহিদগণ সরাসরি সেই উঁচু ঘাসের বনে ঢুকে পড়লেন। অগ্রভাগের সকলেই ছিলেন অশ্বারোহী।
ঘোড়ার পদাঘাতে কর্দমাক্ত মাটি থেকে পানি ছিটকে পড়ছিল। অশ্বারোহী মুজাহিদগণ এই সামান্য পানির পরোয়া না করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাদের পিছনে পদাতিক বাহিনীও ঘাসের বনে প্রবেশ করে সামনের দিকে চলতে লাগল। হঠাৎ সারির একেবারে প্রথম দিকের অশ্বারোহীদের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনা গেল। তারা এলোপাথারী ছুটাছুটি শুরু করে দিল। তারা কিছুটা গভীর পানিতে চলে গিয়েছিল। ঘোড়াগুলো অত্যন্ত জোরে জোরে চিৎকার করছিল, আর আরোহীর নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছিল। মনে হচ্ছিল, ঘোড়াগুলো মহাবিপদ আক্রান্ত হয়েছে।
পদাতিক মুজাহিদদের মধ্যে যারা ঘাসের বনে কিছু দূর অগ্রসর হয়েছিল, তারা পিছন দিকে ফিরে ভাগতে শুরু করল। তাদের কয়েকজন কাদায় লুটোপুটি খাচ্ছিল, আর ভয়ঙ্করূপে চিৎকার করে বলছিল, বাঁচও! বাঁচাও! আমাদেরকে বাঁচাও!!!
তাদের সামনে তিন-চারটি ঘোড়া এমনভাবে চিৎকার করছিল যে, মনে হচ্ছিল ঘোড়াগুলো হায়েনার কবলে পড়েছে।
‘কুমির। কুমির!!’ কেউ একজন চিৎকার করে বলল। ঝাঁকে ঝাঁকে কুমির।
স্যাঁতসেঁতে মাটি আর পানি জমে থাকার কারণে ঘাসগুলো অনেক উঁচু হয়ে গিয়েছিল। এগুলো ঘাস নয়; বরং ঘাসের মত দেখতে এক ধরনের জলজ-উদ্ভিদ। এগুলো এত ঘন যে, নিচে পানির চিহ্ন পর্যন্ত দেখা যায় না। সামনের দিকে পানি কিছুটা গভীর। অশ্বারোহী আর পদাতিক মুজাহিদগণ সামনে অগ্রসর হলে কুমিরগুলো তাদের উপর আক্রমণ করে বসে। কুমির সাধারণত এমনই আর্দ্র ও সঁতসেঁতে মাটিতে বসবাস করে। কুমিরের সংখ্যা দেড়-দুইশ’র চেয়ে কম ছিল না। কুমিরগুলো একাযোগ আক্রমণ করে কয়েকটি ঘোড় ও কয়েকজন পদাতিক মুজাহিদকে টেনে-হেঁচড়ে গভীর পানিতে ধরে নিয়ে যায়। অন্যরা পড়িমড়ি করে কোন রকমে জান নিয়ে পালিয়ে এলো। অগত্যা মুজাহিদ বাহিনী রাস্তা পরিবর্তন করে পাহাড়ী পথ ধরে সামনে অগ্রসর হল।
***
নির্দিষ্ট দূরত্ব পার হয়ে মুজাহীদ বাহিনী নিয়মিত যাত্রা বিরতি দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের মানসিক অবস্থা পূর্বের মতই চাঙ্গা ছিল। কিন্তু তাদের দৈহিক অবস্থা ছিল একেবারে শোচনীয়। তারিক বিন যিয়াদের উৎসাহ উদ্দীপক কথা আর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার বদৌলতে গোটা বাহিনী দীপ্ত কদমে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। মুজাহিদ বাহিনী যতই সামনে অগ্রসর হচ্ছিল, পথের দুর্গমতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
এক দিনের কথা। মুজাহিদ বাহিনী সামনে অগ্রসর হচ্ছিল এমন সময় সম্ভব দিক থেকে চারটি ঘোড়া এগিয়ে এলো। দুটি ঘোড়র উপর দুজন সওয়ারী ছিল। তৃতীয় ঘোড়ার উপর একজন মুজাহিদকে এমনভাবে রাখা ছিল যে, তার মাথা এক দিকে, আর পাও আরেক দিকে ঝুলছিল। তার কাপড় ছিল রক্তে রঞ্জিত। চতুর্থ ঘোড়র উপর একটি সিংহ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সিংহটির দেহে তিনটি তীর বিদ্ধ হয়ে আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেল যে, এই চারজন মুজাহিদ তাদের বাহিনীর চেয়ে অনেক আগে আগে পথ চলছিল। চারজনের মধ্যে সকলের পিছনে যে ছিল, তার উপর সিংহ আক্রমণ করে বসে। ঘোড়া ভয় পেয়ে গতি বাড়িয়ে দেয়। সিংহও ঘোড়াকে লক্ষ্য করে দৌড়াতে থাকে। ঘোড়া এত তীব্র গতিতে ছুটে চলছিল যে, ঘোড়ার আরোহী ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। অন্য তিনজন সিংহকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে মারে। সিংহ মরতে মরতে আরেকজনের উপর আক্রমণ করে তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। যে দুইজন সিংহের আক্রমণ থেকে বেঁচে গিয়েছিল, তারা শহীদ মুজাহিদের জানাযা আদায় করে সেখানেই তাকে দাফন করে দেয়। তারপর আহত মুজাহিদকে ঘোড়ায় উঠিয়ে মূল বাহিনীর সাথে এসে মিলিত হয়।