উত্তর আফ্রিকা আর আরবের মরুভূমির মাঝে লালিত-পালিত হওয়া মুজাহিদ বাহিনী যখন জলাভূমির বিশাল-বিস্তৃত এলাকায় প্রবেশ করল তখন এই জলাভূমিকে তাদের কাছে পৃথিবীর স্বর্গ মনে হল। চার দিকে থরে থরে সাজানো সবুজের নিসর্গ আর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য তাদের ক্লান্ত দেহে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিল। ঘোড়াগুলো পর্যন্ত ‘দুলকি চালে চলতে লাগল।
তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী সামনে অগ্রসর হলে একটি নদী দেখতে পেল। নদীটি তেমন একটা গভীর ছিল না। মাঝখানে কমর পানি হবে। নদী পার হওয়া মুজাহিদদের জন্য তেমন কঠিন কোন বিষয় ছিল না। কিন্তু এই পাহাড়ী নদীটি এতটাই খরস্রোতা যে, কোন শক্তিশালী মুজাহিদের পক্ষেও পাও জমিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব ছিল। অস্বাভাবিক স্রোতস্বিনী হওয়ার সাথে সাথে নদীর পানি এতটাই হীমশীতল ছিল যে, শরীরে লাগলে মনে হত, এখনই রক্ত জমে বরফ হয়ে যাবে। পানিতে পা রাখার সাথে সাথে ঘোড়াগুলো পর্যন্ত ঠাণ্ডার প্রচণ্ডতায় ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল। মুজাহিদদের সামানপত্র গাধার উপর রাখা ছিল। ঘোড়াগাড়ি বা গাধাগাড়ি সাথে আনা হয়নি। কারণ, তারিক বিন যিয়াদকে বলা হয়েছিল, জলাভূমিতে রাস্তা এতটাই সংকির্ণ হবে যে, গাড়ি নিয়ে পথ চলা সেখানে কিছুতেই সম্ভব হবে না।
চারজন অশ্বারোহী আগে আগে চলছিল। একজন আরেকজনের থেকে এতটা দূরতৃবজায় রেখে নদী পার হচ্ছিল, যাতে অন্যদের আওয়াজ শুনতে পারে। সবার আগে যে ছিল, সে কোন অসুবিধা দেখলে তার পিছনের সিপাহীকে আওয়াজ দিত। আর সে আওয়াজ দিত তার পিছনের জনকে। এভাবে সর্বশেষ ব্যক্তি পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছে যেত। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক, সিপাহী জানতে পারত, সামনে কোন বাঁক থাকলে কীভাবে তা পার হতে হবে।
অনেক কষ্ট স্বীকার করে মুজাহিদ বাহিনী খরস্রোতা এই নদী পার হয়ে বড় জোর দুই মাইল পথ অতিক্রম করে দেখেন, সামনে পূর্বের ন্যায় আরেকটি খরস্রোতা নদী। মুজাহিদগণের কাপড় তখনও ভেজা ছিল। কাপড় থেকে ফুটা ফুটা পানি ঝরে পড়ছিল। নদীর গভীরতা পূর্বের নদীর মতই কমর পর্যন্ত। কিন্তু স্রোত পূর্বের নদীর চেয়েও অনেক বেশি। এই নদীটিও মুজাহিদ বাহিনী হাত ধরাধরি করে পার হয়ে গেলেন। অশ্বারোহীগণ অনেকটা সহজে তাদের অশ্বগুলোকে নদী পার করে নিতে সক্ষম হলেন। কিন্তু একেকটি গাধাকে ঠেলে-ধাক্কিয়ে নদী পার করতে গিয়ে কয়েকজন নওজোয়ান মুজাহিদকে রীতিমত গলদঘর্ম হতে হল। তারপরও চার-পাঁচটা খচ্চর নদীর মাঝখানে এসে আর স্থির থাকতে পারল না। পানির তীব্র স্রোতে সেগুলো ভেসে গেল। কোন একজন সালার পেছন থেকে চিৎকার করে বললেন, যেসব খচর ভেসে গেছে, সেগুলোকে উদ্ধারের চেষ্টা করো না, অন্যথায় তোমরাও ভেসে যাবে। জলাভূমির রহস্যময় সৌন্দর্য প্রথম আঘাতেই চারটি জীবন ছিনিয়ে নিল।
***
তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী যত সামনে অগ্রসর হচ্ছিল জলাভূমির রহস্যময় সৌন্দর্য ততই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছিল। জলাভূমির স্থানে স্থানে কাঁটাদার বৃক্ষের ঘন ঝোঁপ-ঝাড় ছিল। কোন কোন স্থানে এসব কাঁটাদার ঝোঁপ-ঝাড় এতই ঘন ছিল যে, সেগুলো অতিক্রম করা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। এসব ধন ঝোঁপ-ঝাড়ের কারণে সূর্যের কিরণ মাটি পর্যন্ত পৌঁছতে পারত না। মাটি এতটাই আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে ছিল যে, পদাতিক সৈন্যদের চলতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। এই কাঁটাদার ঘন ঝুপ-ঝাড় পেরোতে মুজাহিদ বাহিনীর পূর্ণ দুই দিন লেগে গেল। সমতল ভূমিতে এই বাহিনী দুই দিনে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মাইল পথ অতিক্রম করতে সক্ষম ছিল। কিন্তু কাঁটাশুলের জঙ্গলে দুই দিনে দশ মাইল পথ অতিক্রম করাও সম্ভব হয়নি। তার উপর দুই দিনের মধ্যবর্তী রাতে মুজাহিদ বাহিনীকে যাত্রা বিরতি করতে হয়েছে।
জলাভূমির পুরো এলাকায় কেবলমাত্র কাঁটাগুলোর জঙ্গলই ছিল না, বরং স্থানে স্থানে ছোট-বড় পাহাড়ী টিলা আর বড় বড় পাথরে চাইও ছিল। খানাখন্দ আর চড়াই-উতরাইও ছিল ভয়াবহ রকমের। মুজাহিদ বাহিনী একবার উপরে উঠছিল, আরেকবার নিচে নামছিল। পা পিছলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল পদে পদে। ঘোড়াগুলো তো কোন রকমে পা জমিয়ে চলে যাচ্ছিল; কিন্তু পদাতিক মুজাহিদগণের অনেক কষ্ট হচ্ছিল। তারা একজন আরেকজনকে ধরে ধরে চড়াই-উতরাই পার হচ্ছিল।
সিপাহসালার তারিক বিন যিয়াদ এমন ভীতিকর ও অপ্রতিকূল অবস্থায় কেবলমাত্র নিজ বাহিনীকেই নয়; বরং গোটা উম্মতে মুহাম্মদীকে এক নতুন পথের দিশা দিচ্ছিলেন। তিনি তার বাহিনীর সাথে নীরবে পথ চলছিলেন না, বরং তিনি বাহিনীর প্রথম ব্যক্তি থেকে শেষ ব্যক্তি পর্যন্ত ঘোড়া দৌড়িয়ে যেতেন এবং চিৎকার করে সকলের মনোবল চাঙ্গা করতেন। তিনি তার বাহিনীর প্রত্যেক নওজোয়ানকে লক্ষ্য করে বলছিলেন :
‘এই খরস্রোতা নদী, আর নদীর হীম-শীতল পানি তোমাদেরকে আটকে রাখতে পারবে না।’
পাহাড়ের বুক চিরে বের হয়ে যাওয়ার মত ক্ষমতা তোমাদের আছে।’
‘আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন।’
হে আল্লাহর সিংহ-শার্দুল! তোমাদের মনযিল অতি নিকটে।
‘তোমরা তো জান্নাতের দিকে পথ চলছ।’
‘গোটা আন্দালুসিয়া তোমাদের। আন্দালুসিয়ার ধন-ভাণ্ডার তোমাদের।’
‘মুখে আল্লাহর নাম আর বুকে হিম্মত নিয়ে এগিয়ে চল।’