প্রচণ্ড দুঃখ-কষ্টে আক্ষেপ করে মুসা বিন নুসাইর বলে উঠলেন। তারা এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, যে দিনের আলোতে ইনসাফ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আত্মবিস্মৃত হয়ে থাকত। আর নিঝুম রাতের আঁধারে আল্লাহর দরবারে সেজদায় পড়ে থাকত। সে ছিল আধার রাতের এবাদতগুজার, আর যুদ্ধদিনের সিপাহী শাহসওয়ার। সে দিনে রোজা রাখত, আর রাতে জায়নামাযে বিনিদ্র রজনী কাটাত।
মুসা বিন নুসাইর যে কারাগারে পুত্র শোকের অসহ্য যন্ত্রণা বুকে নিয় তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সেই একই কারাগারে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন সিন্ধু বিজয়ী বীরপুরুষ মুহাম্মদ বিন কাসেম। খলীফা সুলায়মানের নির্দেশে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। নির্মম অত্যাচারের অসহ্য যাতনা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন।
“তোমরা এমন এক যুবককে হত্যা করে ফেলছ, যে আর দশটা যুবকের মতো নয়।’
আরেক সিংহপুরুষের হৃদয় বিদারক আর্তচিৎকারেও এই কারাপ্রাচীরের ইট-পাথরগুলো প্রকম্পিত হয়েছিল। খলীফা সুলায়মানের নির্দেশে তাকেও হত্যা করা হয়। সেই মহান মুজাহিদ হলেন, সমরকন্দ বিজেতা কুতায়বা বিন মুসলিম। মৃত্যুর পূর্বে তিনি নিস্তদ্ধ কারাপ্রাচীরের মধ্যে চিৎকার করে বলেছিলেন :
হে রাসূলে আরাবীর উম্মত! আমি তো তোমাদের উন্নতি আর মঙ্গলের জন্য সচেষ্ট ছিলাম। সেই আমাকেই তোমরা বাঁচতে দিলে না। আজ তোমাদের উপর যে অধঃপতন, আর ধ্বংস নেমে এসেছে, তা থেকে তোমাদেরকে কে বাঁচাবে?
আন্দালুসিয়ার আমীর আবদুল আযীয শহীদ হওয়ার পর মুসা বিন নুসাইর বেশি দিন বাঁচেননি। তার এক-দেড় বছর পর সুলায়মান বিন আবদুল মালেকও মৃত্যুবরণ করেন।
এটা কোন কল্পকাহিনী নয়। এটা এমন এক ঈমানদীপ্ত উপাখ্যানের শেষ পরিণতি, যার শুরু হয়েছে পাঁচই রজব ৯২ হিজরী মোতাবেক ৯ই জুলাই ৭১১ খ্রিস্টাব্দে। যখন একজন খ্রিস্টান প্রশাসক মিসর ও আফ্রিকার আমীর মুসা বিন নুসাইরের দরবারে এসে ফরিয়াদ করেন, আন্দালুসিয়ার বাদশাহ রডারিক তার কুমারী মেয়ের শ্লীলতাহানী করেছে। সে এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে চায়। মুসলমানদের মদদ ছাড়া তার একার পক্ষে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। সেই খ্রিস্টান প্রশাসককে সাহায্য করার জন্য মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদকে ডেকে পাঠান।
২. দামেস্কের কারাগারে
০২.
দামেস্কের কারাগারের একটি ছোট্ট অন্ধকার কুঠরী। সারা দিনের ভিক্ষাবৃত্তি শেষে মুসা বিন নুসাইরকে এই অন্ধকার কুঠরীতেই রাত্রি অতিবাহিত করতে হয়। তিনি যখন তাঁর ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহটি সেই ছোট্ট অন্ধকার কুঠরীতে এলিয়ে দিতেন তখন তাঁর বিগত জীবনের একেকটি ঘটনা ছবির মতো তাঁর মনের পর্দায় ভেসে উঠত। স্মৃতিগুলো একে একে চোখের সামনে এসে জড়ো হত।
অতীত দিনের কোন ঘটনাই তিনি মনে করতে চাইতেন না। অতীতের প্রতিটি স্মৃতি তাঁর হৃদয়-স্পন্দন বাড়িয়ে দিত। হৃদয়ের এই স্পন্দন তাঁর নিকট মৃত্যুযন্ত্রণার মতো মনে হত। তিনি বুক ভরা ব্যাথা নিয়ে পরাজিত ও বঞ্চিত জীবনের শেষ দিনটির অপেক্ষা করছিলেন।
তাঁর মনে কোন আফসোস নেই। নেই কোন অতৃপ্তি। তাঁর অশান্ত মনের একমাত্র প্রশান্তি এই যে, তিনি আল্লাহর দ্বীনের পয়গাম আটলান্টিক মহাসগরের পাদদেশ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন।
অপরাধ না করেও তিনি যে অপরাধের শাস্তি ভোগছেন, এ জন্য আল্লাহর কাছে তিনি কোন অনুযোগ করেননি। তিনি ভালো করেই জানেন, আল্লাহ তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট নন। পার্থিব সকল বন্ধন থেকে তিনি মুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। মানসিকভাবে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, এই কারাগারেই তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। আর অজ্ঞাত কোন স্থানে তাকে দাফন করে দেওয়া হবে। হয়তো বা তাঁর জানাযার নামাযও পড়া হবে না।
তিনি ভাবতেও পারছিলেন না যে, ইতিহাসের পাতায় তিনি অমর হয়ে থাকবেন। যত দিন সূর্যের উত্তাপে পৃথিবী সজীব থাকবে, চাঁদ-সেতারা রাতের আকাশ আলোকিত করবে, তত দিন ইতিহাসের বুকে মুসা বিন নুসাইরের নাম থাকবে। তাঁর বিজয়গাথা মানব হৃদয়ে ঈমানের দ্যুতি ছাড়াবে।
তিনি জানতেন না, তারিক বিন যিয়াদ এখন কোথায়? খলীফা দুজনকেই দামেস্ক ডেকে এনেছিলেন। তারিক বিন যিয়াদের কথা চিন্তা করে মুসা বিন নুসাইরের আফসোস হচ্ছিল। আন্দালুসিয়া-বিজয়ী নওজোয়ান এই সিপাহসালারের সাথেও হয়তো এমনই আচরণ করা হচ্ছে। তিনি বোধ হয়, এই কারাগারের কোন অন্ধকার কুঠরীতে বন্দী হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
মৃত্যুপথযাত্রী মুসা বিন নুসাইয়ের মন আজ দুঃখে ভারাক্রান্ত। লাঞ্ছনা-গঞ্জনার ভারে ন্যুজ। অতীত দিনের স্মৃতিগুলো অবচেতন মনে বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠে।
এই তো সে দিনের কথা। উত্তর আফ্রিকার ছোট্ট একটি রাজ্য সিউটার গভর্নর জুলিয়ান তাঁর নিকট এলো। সে দিনের পুরো দৃশ্যটাই তাঁর চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠল। ঐদিন তিনি উত্তর আফ্রিকার একটি শহর তানজানিয়ায় অবস্থান করছিলেন।
তিনি মিসর ও আফ্রিকার আমীর নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে একটি মুহূর্তের জন্যও নিশ্চিন্তে কোথাও বসে থাকতেন না। কখনও একাই শত্রুর মোকবেলায় জেহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কখনও সৈন্য পরিচালনায় শাহসওয়ারের ভূমিকা পালন করতেন। আবার কখনও সুদক্ষ সমাজ সংস্কারকের ন্যায় সংস্কারকর্মে আত্মনিয়োগ করতেন। কখনও শহরে-গঞ্জে কখনও গ্রামে-বন্দরে ঘুরে ঘুরে রাজ্যের সঠিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতেন।