‘আন্দালুসিয়ার আমীর আবদুল আযীযকে হত্যা করে তার মস্তক দামেস্ক পাঠিয়ে দাও। কেউ যেন জানতে না পারে।’
‘যায়েদ, তুমি তো জান, মুসা বিন নুসাইরের সাথে আমার বন্ধুত্ব কতটা গভীর হাবীব বলল। আমি তার ছেলের মস্তক কাটার নির্দেশ দিতে পারি না। এ কাজ আমার দ্বারা কিছুতেই হবে না।’
‘তাহলে নিজেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। যায়েদ বলল। খলীফার নির্দেশ না মানলে সে তোমার পরিবারের প্রত্যেকটি শিশু-সন্তানকে পর্যন্ত হত্যা করে ছাড়বে। হত্যা করার পূর্বে তোমাকে কয়েদখানায় বন্দী করে এমন নির্মম নির্যাতন। করবে যে, দিন-রাতে অসংখ্যবার তুমি মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে যাবে।
‘তুমি কি এ ব্যপারে আমাকে সাহায্য করবে?’ হাবিব যায়েদকে জিজ্ঞেস করল।
‘তুমি বললে অবশ্যই সাহায্য করব। যায়েদ বলল। খলীফার এই নির্দেশ পালন করা ছাড়া তোমার কোন উপায় নেই।’
****
ইউরোপিয়ান ও মুসলিম ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রায় সকলেই লেখেছেন যে, হাবীব বিন উবায়দা এবং মুসা বিন নুসাইরের সাথে অত্যন্ত গভীর বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু মরহুম খলীফা ওলিদ এবং তাঁর ভাই সুলায়মানের পক্ষ থেকে হাবীবের খান্দানের উপর এমন অজস্র অনুগ্রহ ছিল, যা অস্বীকার করা হবীবের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল। তাছাড়া সুলায়মানের প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাবের কারণেও এই নির্দেশ অমান্য করা সম্ভব ছিল না।
অনেক চেষ্টার পর হাবীব পাঁচজন ফৌজি অফিসারকে নিজের মতের সাথে একাত্ম করতে সক্ষম হল। এই পাঁচজন ফৌজি অফিসারই ছিল উমাইয়া বংশের। তারা আমীর আবদুল আযীযকে হত্যা করার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছল।
কিন্তু সমস্যা হল, আমীর আবদুল আযীয জনকল্যাণমূলক কাজে ও সামাজিক উন্নয়নকল্পে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, কখনও তিনি এক জায়গায় স্থির থাকতে পারেন না। আন্দালুসিয়ার কয়েকটি জায়গায় তখনো লড়াই চলছিল। খ্রিস্টানরা মুসলমানদেরকে আন্দালুসিয়া থেকে বিতাড়িত করতে একেবারে অক্ষম হয়ে পড়েছিল। কিন্তু যে সকল অঞ্চল তখনো মুসলমানদের করতলগত হয়নি সেগুলো রক্ষার জন্য খ্রিস্টানরা প্রাণপণ লড়াই করছিল। আমীর আবদুল আযীয কখনও কখনও আকস্মিকভাবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে চলে যেতেন।
আমীর আবদুল আযীযকে হত্যা করার জন্য গুপ্তঘাতকদের লেলিয়ে দেওয়া হল। তারা কয়েকবারই চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য চেষ্টা করল; কিন্তু তাদের প্রতিটি প্রচেষ্টাই চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল। আবদুল আযীয নিজেও আঁচ করতে পারেননি যে, কেউ তাঁকে হত্যা করার জন্য ছায়ার মতো তার পিছনে লেগে আছে।
অবশেষে হাবীব বিন উবায়দা এক বিকৃত মস্তিষ্ক গুপ্তঘাতকের সন্ধান পেল। সে অত্যন্ত সাহসী ও ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন ছিল। সে ছায়ার মতো আমীর আবদুল আযীযের পিছনে লেগে থাকত। আমীর আবদুল আযীয সর্বদা দেহরক্ষী বেষ্টিত হয়ে থাকতেন। তাঁর পর্যন্ত একটি তীর পৌঁছাও ছিল অসম্ভব।
এই গুপ্তঘাতকের নাম কোন ঐতিহাসিকই উল্লেখ করেননি। গুপ্তঘাতক একটি মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় ছিল। তখনকার যুগে যিনি সিপাহসালার হতেন তিনিই ইমামতের দায়িত্ব পালন করতেন। জামে মসজিদের ইমামতের দায়িত্ব তাঁর উপরই ন্যস্ত থাকত।
একদিন আমীর আবদুল আযীয ফজরের নামাযের ইমামতের জন্য দাঁড়িয়েছেন। তিনি সূরা ফাতেহা তিলাওয়াত করে সুরা ওয়াকিয়া শুরু করেছেন মাত্র। এমন সময় এক ব্যক্তি বিদ্যুৎগতিতে প্রথম কাতার থেকে বের হয়ে, চোখের পলকে তলোয়ারের এক আঘাতে আমীর আবদুল আযীযের শরীর থেকে মস্তক আলাদা করে ফেলল। নামাযীগণ কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই গুপ্তঘাতক মস্তক নিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
গুপ্তঘাতক আমীর আবদুল আযীযের কর্তিত মস্তক কাপড়ে পেঁচিয়ে হাবীব বিন উবায়দার ঘরে এসে পৌঁছল। হাবীব তার অপেক্ষায় ছিল। সে চামড়ার একটি থলি বানিয়ে রেখেছিল। কর্তিক মস্তক সেই থলিতে রেখে সেলাই করে আরেকটি মখমলের থলিতে ভরে বার্তাবাহক আবু নসরকে দিয়ে বলল, এটা খলীফা সুলায়মান বিন আবদুল মালেকের নিকট পৌঁছে দাও।’
‘কি আছে এর মধ্যে? বার্তাবাহক জিজ্ঞেস করল।
‘খলীফার পয়গামের উত্তর। হাবীব বলল। এখনই রওনা হয়ে যাও।’
আবু নসর তৎক্ষণাৎ বের হয়ে পড়ল। সে প্রায় বিশ দিন লাগাতার সফর করে দামেস্ক এসে পৌঁছল। দামেস্ক পৌঁছেই সে খলীফার সাথে সাক্ষাৎ করল। হাবীব খলীফার পয়গামের উত্তর হিসেবে যে থলি তাকে দিয়ে ছিল, সেই থলি সে খলীফার সামনে পেশ করল।
খলীফা সুলায়মান থলির মধ্যে আমীর আবদুল আযীযের কর্তিত মস্তক দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। তিনি চিৎকার করে নির্দেশ দিলেন, ‘আন্দালুসিয়ার আমীরের কর্তিত মস্তক কয়েদখানায় তার বাবার সামনে রেখে এসো।’
সাথে সাথে তার নির্দেশ পালন করা হল। আমীর আবদুল আযীযের কর্তিত মস্তক মুসা বিন নুসাইরের সামনে পেশ করা হল।
মুসা বিন নুসাইর প্রথম থেকেই অসহনীয় দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত ছিলেন। নিত্য নতুন নির্যাতন, আর অনাহারে-অর্ধাহারে তাঁর শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। শারীরিক ও মানসিক আর কোন প্রকার দুঃখ সহ্য করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এমন সময় প্রিয় পুত্রসন্তানের কর্তিত মস্তক দেখে তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে যান। হুঁশ ফিরে এলে দেখেন, মস্তক সেখানে নেই।