কুলসুম তাকে একটি কুরসীতে বসিয়ে নিজে একটি কুরসী টেনে বসে বলল, “তিনি আন্দালুসিয়া যাওয়ার খোয়ব দেখছেন। তুমি হলে তার প্রধান পরামর্শদাতা, তার পরামর্শদাতা তো আরো অনেকেই আছে, কিন্তু আমি তোমাকে তার মনের মাঝে স্থান করে দিয়েছি।’
‘এটা কোন নতুন কথা নয়।’ আবু হানিফ বলল। নতুন কথা বল, বার্তাবাহক কি সংবাদ এনেছে, আর সুলায়মানই বা কি বলেছে?
কুলসুম আবু হানিফকে বার্তাবাহকের সব কথা শুনাল। বার্তাবাহকের কথা শুনে সুলায়মানের কী প্রিতিক্রিয়া হয়েছিল এবং সে নিজে সুলায়মানকে কী পরামর্শ দিয়েছে তাও শুনাল।
‘আমিও তাকে এই পরামর্শই দেব।’ আবু হানিফ বলল। সুলায়মানের সালতানাত যত দিন স্থায়ী হবে তত দিন আমাদের ভাগ্যও সুপ্রসন্ন থাকবে। কিন্তু মনে রেখো কুলসুম, মুসা বিন নুসাইর আন্দালুসিয়ার যে সকল দাসী-বান্দি তোহফা স্বরূপ খলীফা ওলিদের নিকট পাঠিয়ে ছিল, তাদের প্রত্যেকেই অত্যন্ত রূপসী ও লাস্যময়ী রূপে-গুণে তাদের কোন তুলনা হয় না। এ সকল খ্রিস্টান মেয়েদের বিবেক-বুদ্ধি অত্যন্ত প্রখর। আমি ভালো করেই জানি, এ সকল মেয়েরা সেখানে দাসী-বান্দি ছিল না। তারা সকলেই শাহীখান্দানের মেয়ে। তাদের কেউ যেন তোমাকে পিছনে ফেলে সুলায়মানের হৃদয়-মন্দিরে জায়গা করে না নেয়।
‘এ বিষয়ে পরেও কথা বলা যাবে।’ কুলসুম বলল। এখন সুলায়মান তোমাকে ডাকছে, সে আন্দালুসিয়ার আমীর আবদুল আযীযের ব্যাপারে তোমার। সাথে পরামর্শ করতে চায়।’
‘তাকে কী পরামর্শ দেব?’ আবু হানিফ জানতে চাইল।
কুলসুম তার ডান হাত ছুরির মতো করে গর্দান স্পর্শ করে বলল, জলদি যাও। সুলায়মান তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তাকে আন্দালুসিয়া যাওয়ার পরামর্শ দিও না।
আবু হানিফ দ্রুত সুলায়মানের কামরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। সে কামরায় প্রবেশ করতেই সুলায়মান তাকে নিয়ে গোপন বৈঠকে বসলেন।
***
সেদিন আপরাহ্নে দামেস্ক থেকে একজন বার্তাবাহক আন্দালুসিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। তার সাথে ছিল একটি লিখিত পয়গাম। লিখিত পয়গামটি একটি চামড়ার থলিতে ভরে আবু হানিফ সুলায়মানের সামনে মোহর অঙ্কিত করল। সুলায়মান আবু হানিফকে দিয়ে পয়গামটি লিখিয়ে ছিলেন।
ইতিহাসে বার্তাবাহকের নাম লেখা আছে আবু নসর। এই বার্তাবাহককেই পূর্ববর্তী খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেক পাঠিয়ে ছিলেন মুসা বিন নুসাইরকে আন্দালুসিয়া থেকে ডেকে আনার জন্য।
আবু নসর ছিল রাজকর্মচারীদের মাঝে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। সুলায়মান আবু নসরকে লিখিত পয়গামটি দিয়ে বললেন, তুমি ভালো করেই জান, আমার বড় ভাই ওলিদ তোমার উপর কতটা আস্থা রাখতেন। শাহীমহলে তোমার প্রতি সেই আস্থা এখনও অটুট আছে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়গাম। কোন অবস্থাতেই যেন রাস্তায় এই পয়গাম ভোলা না হয়। কোন কারণে যদি এই পয়গাম হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, তাহলে মোহর ভেঙ্গে থলি থেকে পয়গাম বের করে জ্বালিয়ে দেবে অথবা গিলে ফেলবে। এই পয়গাম কোনভাবেই যেন অন্যের হাতে না পৌঁছে।’
‘আমীরুল মুমিনীন, এমনই হবে।’ আবু নসর বলল।
‘আরেকবার ভালো করে শুনে নাও।’ সুলায়মান বললেন। পয়গাম হাবীৰ বিন উবায়দার হাতে পৌঁছাবে। কেউ যেন জানতে না পারে যে, তুমি কোন পয়গাম নিয়ে গিয়েছ। তাছাড়া আর সব কিছুই তো তোমাকে বলে দেওয়া হয়েছে।
আবু নসর সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে আন্দালুসিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।
***
আন্দালুসিয়ার রাজধানী টলেডো। আমীর আবদুল আযীয টলেডোতেই অবস্থান করছিলেন। আবু নসর রাতের বেলা টলেডোর উপকণ্ঠে এসে পৌঁছলো। সন্ধ্যায় শহর রক্ষা প্রাচীরের ফটক বন্দ হয়ে যাওয়াতে শহরের বাইরেই তাকে রাত যাপন করতে হয়েছে। ফটক খোলা হলে সে শহরে প্রবেশ করল।
পূর্বেই সে তার চেহারায় কিছুটা পরিবর্তন এনেছিল। সে এমন লেবাস পরেছিল যে, তাকে আরব বরে মনে হচ্ছিলো না। পূর্বেও সে এখানে এসেছে, তাই এখানের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সম্পর্কে তার ধারণা ছিল। সে জানত, হাবীব বিন উবায়দা কোথায় থাকে।
ঐতিহাসিকদের মতে হাবীব বিন উবায়দা ছিল ফৌজের উচ্চ পদস্থ একজন কর্মকতা। সম্ভবত এ কারণেই তার নামের সাথে আমীর শব্দটি লেখা হত।
আবু নসর হাবীবের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। এ সময় হাবীবের এক দোস্ত–যায়েদ বিন নাবাহ সেখানে উপস্থিত ছিল। খাদেম এসে বলল, একজন মুসাফির আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়।’
হাবীব বাইরে এসে আগন্তুকের দিকে এক দৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল। তুমি আবু নসর নও? কারো জন্য খলীফার পয়গাম নিয়ে এসেছ নাকি?
‘আপনার জন্যই পয়গাম এনেছি।’ আবু নসর বলল। খলীফার বিশেষ গোপন পয়গাম। তার নির্দেশ হল, কেউ যেন এই পয়গামের ব্যাপারে জানতে না পারে। এই নিন পয়গাম। আর আমাকে আত্মগোপন করে থাকার ব্যবস্থা করে দিন। জবাব নিয়ে আমি ফিরে যাব।’
হাবীব তার থেকে পয়গামের থলি নিয়ে খাদেমকে বলল, এই মুসাফিরের জন্য আলাদা কামরার ব্যবস্থা কর এবং তার খাওয়া-দাওয়ার প্রতি বিশেষ খেয়াল রেখো।
বৈঠকখানায় এসে হাবীব দোস্ত যায়েদের সামনে থলি খোলে পয়গাম বের করে পড়তে লাগল। পয়গাম খুব দীর্ঘ ছিল না। পয়গাম পড়তে গিয়ে হবীব বিন উবায়দার হাত কাঁপতে শুরু করল। তার হাত এতটা সজোরে কাঁপছিল যে, পয়গাম তার হাত থেকে পড়ে গেলো, আর চোখ থেকে কান্নার দমকে তপ্ত অশ্রু বের হয়ে এলো। পড়ে যাওয়া পয়গমটি উঠিয়ে নিয়ে যায়েদ পড়তে লাগল…।