বার্তাবাহক আন্দালুসিয়া থেকে ফিরে সরাসারি খলীফা সুলায়মানের সাথে সাক্ষাৎ করল। সে খলীফাকে সেখানকার পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলল, ‘খলীফাতুল মুসলিমিন! আন্দালুসিয়ার মতো সুন্দর, সবুজ-শ্যামল দেশ সম্ভবত দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি নেই।’
‘আমি কোন দেশের ভৌগলিক বিবরণ শুনতে চাইনি। সুলায়মান বললেন। ‘আমাকে শুধু এই সংবাদ দাও, আমীর আবদুল আযীয কী করছে? সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষ তার সম্পর্কে কিরূপ ধারণা পোষণ করে?’
‘সেনাবাহিনী ও জনসাধারণের নিকট আন্দালুসিয়ার আমীর আবদুল আযীয অত্যন্ত সম্মানিত ব্যাক্তি।’ বার্তাবাহক বলল। তিনি খোদাভীরু ও দুনিয়াবিমুখ আলেমেদ্বীন। আরব ও বার্বাররা তো তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করেই খ্রিস্টানরা পর্যন্ত তাঁর প্রশংসা করে।
আবদুল আযীয আন্দালুসিয়ার জনসাধারনের জন্য কল্যাণকর ও উন্নয়ণমূলক যে কাজ করে যাচ্ছেন, তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে বার্তাবাহক বলল, ‘আন্দালুসিয়ার আমীর আবদুল আযীয সেখানকার লোকদের ভাগ্য পাল্টে দিয়েছেন। সেখানে বিত্তশালী খ্রিস্টানরা বিত্তহীনদের উপর জুলুম-নির্যাতন করত।
যারা স্বর্ণ, মুদ্রা ও ধন-সম্পদের মালিক ছিল, তারাই যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাস-বৈভবের একচ্ছত্র অধিকারী ছিল।
আমীর আবদুল আযীয গরীব জনসাধারণকে এমন এক জীবনের সন্ধান দিয়েছেন যে, তারা এখন শুধু পেট ভরে খানাই খায় না; বরং মানুষ হিসেবে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাও হয়।
‘বাবার সম্প্রদায় আবদুল আযীয সম্পর্কে কেমন ধারণা পোষণ করে? খলীফা বার্তাবাহককে জিজ্ঞেস করলেন।
‘খলীফাতুল মুসলিমিন নিশ্চয় অবগত আছেন, তারিক বিন যিয়াদ যে সকল সৈন্য নিয়ে আন্দালুসিয়া আক্রমণ করে ছিলেন তাদের সকলেই ছিল বার্বার। মালে গনিমত হিসেবে যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ বার্বারদের হস্তগত হয়েছিল, তা তারা স্বপ্নেও কখনও দেখেনি। আমীর আবদুল আযীয বার্বারদের অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। তিনি তাদেরকে অত্যন্ত সম্মানিত করেছেন। মুসা বিন নুসাইর দীর্ঘকাল আফ্রিকার আমীর ছিলেন। বার্বারদের উপর তার অনুগ্রহ এত বেশি যে, বার্বাররা তাকে পীর-মুরশেদ মনে করে। এ কারণেই বার্বাররা আবদুল আযীযের জন্য নিজেদের জান-মাল কোরবান করতে সদা প্রস্তুত থাকে।
‘ওখানে কি কেউ আমাদের প্রশংসাও করে?’ সুলায়মান জিজ্ঞেস করলেন।
‘খলীফা অভয় দিলে এ ব্যাপারে অধমের কিছু কথা আছে।’ বার্তাবাহক বলল।
‘নির্ভয়ে বল।’ খলীফার পরিবর্তে কুলসুম বলে উঠল। সে খলীফার শরীরের সাথে লেগে বসেছিল।
‘খলীফাতুল মুসলিমীন!’ বার্তাবাহক বলল। আমি অনেক সরাইখানায় গিয়েছি, সেখানে আমি মুসলমান, খ্রিস্টান এমন কি বার্বার মুসলমানদের সাথেও কথা বলেছি, কিন্তু কেউ দামেস্কের খেলাফতের নাম পর্যন্ত নেয় না। সেখানকার নতুন নির্মিত মসজিদেও আমি গিয়েছি, সেখানেও খলীফার নাম নেওয়া হয় না। লোকদের মুখে মুখে শুধু আমীর আবদুল আযীযেরই নাম।
‘মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন যিয়াদ সম্পর্কে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি।’ সুলায়মান জানতে চাইলেন।
‘আমি অনেককেই দেখেছি, তারা একজন অন্যজনকে জিজ্ঞেস করে, মুসা বিন নুসাইর এবং তারিক বিন যিয়াদ কোথায় গেছেন? বার্তাবাহক বলল। ‘খলীফাতুল মুসলিমীন! যে ব্যক্তিই জানতে পেরেছে যে, আমি দামেস্ক থেকে এসেছি, সেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, মুসা বিন নুসাইর এবং তারিক বিন যিয়া কি দামেস্কে আছেন? তাঁরা কবে ফিরবেন? ইত্যাদি। আমি দেখেছি, দারুল খেলাফতের সাথে আন্দালুসিয়ার কোন সম্পর্কই নেই। খলীফাতুল মুসলিমীন। আপনার সেখানে যাওয়া উচিত।’
‘হ্যাঁ, আমার সেখানে যাওয়া উচিত। আমি যদি সেখানে না যাই তাহলে একদিন খোতবা থেকেও আমার নাম মুছে যাবে।’ সুলায়মান বললেন।
‘তুমি এখন যেতে পার।’ কুলসুম বার্তাবাহককে বলল।
বার্তাবাহক চলে গেলে কুলসুম সুলায়মানকে বলল, ‘আপনি আন্দালুসিয়া যাবেন। আপনি কি বার্তাবাহকের এমন সুস্পষ্ট কথা থেকেও বুঝতে পারেননি যে, আন্দালুসিয়া একদিন একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে? আপনি কি চান, উমাইয়া বংশের হাত থেকে খেলাফতের বাগডোর অন্যের হাতে চলে যাক? আপনি কি মুসার খান্দানকে খেলাফতের মসনদে বসাতে চান?
‘না, কুলসুম! কক্ষণও না।’ সুলায়মান বললেন। আমি মুসার বংশ নির্বংশ করে তবেই ক্ষান্ত হব।
‘মুসা এই অধিকার কোত্থেকে পেল যে, সে নিজের ছেলেকে একটি বিজিত এলাকার আমীর বানিয়ে দিয়েছে। কুলসুম বলল। শুধু মুসাকে খতম করলেই হবে না। তার গোটা বংশকেই খতম করে দিতে হবে।’
‘এখনই আবু হানিফকে ডাক। খলীফার কথা শুনে কুলসুম উঠে দাঁড়াল। খলীফা তাকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ? প্রহরীকে পাঠাও।’
‘আবু হানিফকে ডাকার জন্য আমারই যাওয়া উচিত।’ কুলসুম বলল। সে তো আপনার হুকুমের অপেক্ষায় এখানেই বসে আছে।’
কুলসুম খলীফার কামরা থেকে বের হয়ে দুটি কামরা অতিক্রম করে তৃতীয় একটি কামরায় প্রবেশ করল। কামরাটি অত্যন্ত সুন্দর ও সাজানো-গুছানো। সেখানে মধ্য বয়সী বলিস্ট চেহারার সুদর্শন এক পুরুষ বসেছিল। কুলসুমকে দেখামাত্র সে দাঁড়িয়ে তার দুই বাহু প্রসারিত করে ধরল। কুলসুম সোজা তার বাহুবন্ধনে আশ্রয় নিল। এ লোকটিই হল, আবু হানিফ।