দুই ইংরেজের ধারণা ছিলো, আমি ইংরেজি বুঝি না। অথচ আমি এফ, আই পাশ করে সরাসরি আই, এম, আইতে ভর্তি হয়েছিলাম। ইংরেজ অফিসারদের সঙ্গে ইংরেজিতেই আমি কথা বলি।
এরা তো দেখি আমাকে বেওকুফ বানিয়েছে- কর্ণেল ক্যাপ্টেনকে বললেন নায়েক জগমোহন তো কখনো একথা বলেনি যে, যে লোক তার বোনকে কয়েদি থেকে উদ্ধার করে এনেছে সে নিজেই অনেক বড় বদমায়েশ। এই ইনস্পেক্টর তো জোর সন্দেহ করছে, গ্রামে সে কাউকে হত্যা করে এসেছে।
স্যার! মাফ করবেন- ক্যাপ্টেন বললো- এদেরকে প্রথমেই আমাদের বিশ্বাস করা উচিত হয়নি। এই হিন্দুস্তানিদের রাজনীতিই হলো মিথ্যা বলা। প্রথম দিনই ঐ মেয়ে ও ঐ বদ লোককে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া উচিত ছিলো আমাদের।
শোন ক্যাপ্টেন!- কর্ণেল বললেন- আমি দেখতে চাই, আমাদের হিন্দুস্তানি পুলিশ নিজেদের ডিউটিতে কতটা কার্যকর, আমার কাছে মনে হয়েছিলো, এই মেয়েকে গ্রামের কোন জমিদার বা শেঠ অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন সন্দেহ হচ্ছে, এ নিয়ে ওরা যে কাহিনী শুনিয়েছে সেটা সত্যি নয়……
আমি চাই, নায়েক জগমোহন, তার বোন ও ঐ লোককে পুলিশের হাওলা করে দেয়া হোক। ইনস্পেক্টর এখানেই তদন্ত করে দেখুক। আসল ঘটনা আমিও জানতে চাই। আমি নিজে এই রিপোর্ট ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারকে লিখে পাঠাবো। না হয় এরা নিজেরা আবার এক জোট হয়ে উল্টা পাল্টাও কিছু করে বসতে পারে। তখন সব ঝামেলা আমার ওপর এসে পড়বে….. সুবেদার মেজরকে বলো, ওদেরকে এখানে পাঠিয়ে দিতে।
কর্ণেল আমাকে বললেন, ওদেরকে এখানে আনা হচ্ছে। আমি ইংরেজিতে বললাম, তাহলে তো আমার জন্য কাজ সহজ হয়ে গেলো।
ইনস্পেক্টর! আপনি তো চমৎকার ইংরেজি বলেন। খুশি হলাম।- কর্ণেল বললেন উচ্ছাসিত হয়ে।
***
একটু পর তিনজনকে আমার সামনে উপস্থিত করা হলো। দুর্গাকে দেখেই আমি চিনে ফেললাম। দুটো ডাকাতি কেসে সে আসামীদের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে ছিলো। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা সাক্ষ্য।
ক্যাপ্টেন আমাকে তদন্তের জন্য পৃথক কামরায় নিয়ে গেলেন। সেখানে ছিলো তিনটি চেয়ার ও একটি বড় রেভলিং চেয়ার।
প্রথমে আমি ঐ মেয়েকে ডেকে পাঠালাম।
দেখো, দুলারী- আমি দুলারীর চোখে চোখ রেখে বললাম- গ্রামে গঞ্জে সব ধরনের মিথ্যাচার, ধোকাবাজি চলে। পুলিশ ও আর্মি কর্মকর্তার সামনে যদি মিথ্যা বলো, ইংরেজ অফিসার তোমাকে বাইরে দার করিয়ে গুলি করে মারবে। না হয় সারা জীবনের জন্য তোমাকে জেলে পাঠিয়ে দেবেন। এখন একমাত্র আমিই আছি, যার সামনে তুমি সত্য বললে নিরাপদ থাকবে।
এটা তো অবশ্যই সত্য যে তুমি দুর্গার মতো বদমায়েশের সঙ্গে ঘর থেকে পালিয়ে এসেছে। আর এখানে এসে তুমি তোমার ভাইয়ের মাধ্যমে ইংরেজ অফিসারদের ভিন্ন কথা শুনিয়েছে।
না না- দুলারী এমনভাবে বললো যেন তার গলায় ছুরি চালানো হচ্ছে আমি দুর্গার সঙ্গে ঘর থেকে বের হইনি। আমাদের গায়ের ঠাকুর আমাকে অপহরণ করে তার কাছে বন্দি করে রেখেছিলো। অবশ্য সে আমাকে কোন কষ্ট দেয়নি। অনেক অপ্যায়ন করেছে। আর সবসময় বলেছে, আমাকে বিয়ে করতে চায়।
এই মেয়ের কথা শুনে আমার মনে হলো, পুরো কামরা আমার মাথার সঙ্গে ঘুরছে। কল্পনাও করিনি, এই মেয়ের কেস ঠাকুরের কেসের সঙ্গে এভাবে জট পাকিয়ে যাবে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, ওকে কি জিজ্ঞেস করবো। মনে হচ্ছিলো, কোন সিনেমায় আমি অভিনয় করছি।
তুমি কোন ঠাকুরের কথা বলছো? দুলারীকে জিজ্ঞেস করলাম।
সে ঐ ঠাকুরের কথাই বললো যাকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার নাম ছিলো কালি রায় ঠাকুর।
আমার কথা মন দিয়ে শোন দুলারী। তোমাকে বলেছি আমি মিথ্যা বললে তোমার কি পরিণাম হবে। পুরা ঘটনা তুমি খুলে বলল।
ঘটনা ছিলো এরকম- দুলারী বলতে শুরু করলো। আমি সেদিন সন্ধ্যার একটু আগে আমাদের বকরিগুলো বাড়ি নিয়ে আসছিলাম। গ্রাম থেকে একটু দুরে কয়েকটি টিলা আছে। জায়গাটি খুব নির্জন। সেখান দিয়ে আসার সময় ওপর থেকে হঠাৎ আমার মাথার ওপর মোটা একটা কাপড় এসে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে কেউ আমার দুহাত শক্ত করে ধরে ফেললো। ভয়ে আমি চিৎকার করতে লাগলাম।
তখন আরেকজনের আওয়াজ এলো- ওর মুখ বেঁধে দাও….
ওরা আরেকটি কাপড় দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিলো। তিন চারজন ছিলো। ওদেরকে রুখার মতো শক্তি আমার ছিলো না। তারপর তারা আমাকে নিয়ে একটি ঝোঁপের আড়ালে বসে পড়লো। হয়তো অন্ধকার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো। কথা বলছিলো না কেউ।
অন্ধকার নামার পর তারা আমাকে দুজন করে কাঁধে নিয়ে পথ চলতে লাগলো। পালা করে আমার দেহ কাঁধ বদল হতে লাগলো….
অনেক পর আমার মনে হলো, একটা দরজা খুলেছে। অর্থাৎ আমাকে কোন কামরায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এক কামরায় নিয়ে গিয়ে আমাকে খাটের ওপর নামিয়ে রাখলো ওরা। তারপর আমার মুখের বাঁধন খুলে দিলো। মাথার ওপর থেকে মোটা চাদরটিও সরিয়ে নিলো।
দেখলাম, সেখানে তিন চারজন লোক রয়েছে। দুজনের চেহারা কাপড়ে ঢাকা। ওরা বাইরে বলে গেলো। আমার সামনে এখন দুজন দাঁড়িয়ে। একজন ঠাকুর। আরেকজন ছিলো দুর্গা। দুজনকে দেখে আমি কেঁপে উঠলাম……
আমি যদি খারাপ মেয়ে হতাম তাহলে কোন চিন্তা ছিলো না। কিন্তু আমার কাছে জীবনের চেয়ে ইজ্জত অনেক প্রিয় …….