আমি স্যার…. নিজের দায়িত্ব পালন করেছি। প্রয়োজন হলে আমি এই চিঠির ব্যাপারে সব রকম সাক্ষ্য দেবো। সময় মতো শুধু আমাকে ডেকে পাঠাবেন।
ডাক পিওনকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় করলাম। তারপর আর বিলম্ব করলাম না। সাব ইনস্পেক্টর রাম সাহা ও দুই কনস্টেবলকে নিয়ে হাবিলদারের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম।
এলাকার চৌকিদারের মাধ্যমে হাবিলদারের বাড়ি চিনে নিলাম। দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে দিলো হাবিলদারের বাবা।
বুড়ো তার সামনে দুই পুলিশ অফিসারকে দেখে ভয়ে যেন কাঁপতে লাগলো। আমার ভয় হলো, অজ্ঞান না হয়ে যায় আবার। হাতজোড় করে আবোল-তাবোল বকতে লাগলো।
ভয় নেই চাচা! আমি তার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বললাম আমরা আপনাকে কিছু করতে আসিনি। আপনার ছেলে যে চিঠিটি পাঠিয়েছে সেটা দিয়ে দিন।
হুজুর!- বুড়ো বললো- হুজুর! আমি গরিব মানুষ। আমি চিঠি দিয়ে দেবো। কিন্তু আমাকে থানায় নিয়ে যাবেন না। চিঠি পড়ে দেখুন। আমার ছেলেরও কোন দোষ নেই।
ততক্ষণে ঘরের সবাই জেগে উঠেছে। ভেতরে সঙ্গে সঙ্গে আলোও জ্বালানো হয়েছে। কারো ফুপানির আওয়াজও আসছে। বুঝা গেলো, পুলিশের ভয়ে কাঁদছে। পুলিশ তো আসলে ভালো মানুষের বন্ধু। তাহলে কেন যে পুলিশকে মানুষ এত ভয় পায়!
চিঠি নিয়ে এলো বৃদ্ধ। চিঠিটা পড়ে দেখলাম। চিঠি পড়ে বুঝা গেলো, হাবিলদার এটা জানেন না যে, যে মেয়ের কথা তিনি লিখেছেন সে গ্রাম থেকে লাপাত্তা হয়ে গেছে। আর পুলিশ সারা গ্রামে চিরুনী অপারেশন শুরু করে দিয়েছে। তিনি হয়তো ভেবেছেন, সেই মেয়ে এমনিই তার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করতে এসেছে।
হাবিলদারের বাপকে বললাম, ভয় নেই কোন। তাকে শুধু আমার সাক্ষী বানাবো। শুধু এতটুকু বললেই হবে যে, আমি আমার ছেলের চিঠি পেয়েছিলাম। আর চিঠি ডাক পিওন পড়ে শুনিয়েছে।
ভয় বৃদ্ধকে এমনভাবে জাপটে ধরেছিলো যে, আমার পায়ে পড়ে বলতে লাগলো, যা বলবেন হুজুর তাই করবো। তবুও থানায় নিবেন না।
বৃদ্ধকে আমি উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। এবার বৃদ্ধ যেন কিছুটা আশ্বাস পেলো। তার মুখে হাসি ফিরে এলো।
***
পরদিন ভোরেই লরিতে করে ডিএসপি সাহেবের হেডকোয়ার্টারে রওয়ানা হয়ে গেলাম। লরি এক ঘন্টার মধ্যে সেখানে পেঁছে দিলো। ডিএসপি তখনও অফিসে আসেননি। আমি তখন উত্তেজনায় টগবগ করছি। অপেক্ষা করতে পারলাম না। ডিএসপির বাংলোয় চলে গেলাম।
তিনি তখন তৈরী হয়ে বের হচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই আগুন দৃষ্টিতে ঘুরে তাকালেন। আমি স্যালুট করলাম।
কি রিপোর্ট এনেছো?- তিনি ধমকে উঠলেন- ঐ মেয়ের কেসের রিপোর্ট এনেছে, না অন্য কোন ধান্ধায়?
আমি পকেট থেকে হাবিলদারের চিঠিটা তাকে দিলাম। কাগজের ভাজ খুলে চিঠিটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
পড়ে শোনাও- বিরক্ত হয়ে বললেন- জানো না, আমরা তোমাদের ভাষা শুধু বলতে পারি লিখতে পারি না?
আমি চিঠি পড়ে শুনিয়ে জানালাম কিভাবে এ চিঠি আমার হস্তগত হয়েছে। তারপর ডিএসপি সাহেবের কাছে অনুরোধ রাখলাম, আমাকে যেন জবলপুর সেনা ছাউনির ঐ জাট রেজিমেন্টে যাওয়ার অনুমতিপত্র লিখে দিন, যাতে ওখানে গিয়ে আমি তদন্ত করতে পারি।
আমার অফিসে চলো।
ডিএসপি আমাকে সরকারী অনুমতিপত্র দিয়ে দিলেন। এ দিয়ে আমি যেকোন রেজিমেন্টে গিয়ে তদন্ত কাজ চালাতে পারবো এবং এতে এও লেখা আছে যে, সেনা অফিসাররা যেন আমাকে সহযোগিতা করে।
পর দিন সন্ধ্যায় আমি জবলপুর পৌঁছলাম। সেখানকার পুলিশ হেড কোয়ার্টারে রাতটা কাটালাম।
সকালে সেখানকার এসপির সঙ্গে সাক্ষাত করলাম। পুরো ঘটনা তাকে শোনালাম এবং সরকারি অনুমতি পত্রও দেখালাম। তিনি আর্মি ব্রিগেডিয়ারকে ফোনে কি যেন বললেন এবং আমার পথ পরিষ্কার করে দিলেন।
দিনের সাড়ে এগারটায় আমাকে পৌঁছে দেয়া হলো জাট রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের দফতরে। এতেই দুলারীর ভাই নায়েক জগমোহন আছে। আমার কাগজ দেখলেন তিনি।
ঐ মেয়ে এখানে আছে সেটা আপনি কি করে জানলেন?- ইংরেজ কর্ণেল আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
আমি হাবিলদারের চিঠি তাকে পড়ে শোনালাম। তিনি মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। বললেন,
আমরা যদি চাপ না দিতাম- কর্ণেল বললেন- তাহলে আপনারা পাত্তাই দিতেন না এ কেসকে। আমরা দেখতে চাই, পাবলিকের প্রতি আপনারা কতটুকু খেয়াল রাখেন আর নিজেদের দায়িত্বে কতটুকু যত্মবান।
সাহেব বাহাদুর!- আমি বললাম- যদি একটি মেয়ে এমন একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায় যাকে গ্রামের সবাই বদমায়েশ বলে জানে এবং সবাই অনেক ভয় পায় তাহলে আমাদের তদন্ত কি করতে পারবে? এই চিঠিতে দুর্গা নামে যার কথা এসেছে সে অনেক বড় বদমায়েশ। এতে এক হত্যা মামলায় পুলিশের চোখে আসামী। হত্যার রাত থেকেই এ দুর্গা লাপাত্তা।
আপনি কি নিশ্চিত হত্যার আসামী সেই?
নিশ্চিত তো হওয়া যাবে তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের পর সাহেব বাহাদুর!
তবে পরিস্থিতি ও সাক্ষ্য তার বিরুদ্ধেই যাচ্ছে। আপনার কাছে আমি অনুরোধ রাখছি, ঐ মেয়ে ও দুর্গাকে আমার কাছে হাওলা করে দিন। আপনার রেজিমেন্টের কিছু লোকের জবানবন্দিও আমার প্রয়োজন হতে পারে। আমি আপনার সহযোগিতার জন্য দরখাস্ত পেশ করছি।
কর্ণেল কিছু একটা ভাবতে লাগলেন। তারপর তার ক্যাপ্টেনকে ডাকিয়ে আনলেন। ইংরেজীতে সলাপরামর্শ করতে লাগলেন তারা।