নায়েক চিঠি পেয়ে মামলার তদন্তে গুরুত্ব দেয়ার জন্য তার কমান্ডিং অফিসারের কাছে দরখাস্ত লিখে। কমান্ডিং অফিসার দরখাস্ত পাঠিয়ে দেয় ব্রিগেড কমান্ডারকে। ব্রিগেড কমান্ডার নায়েকের জেলার ডিপুটি কমিশনারকে এ ব্যপারে দরখাস্ত সংযুক্ত করে এক হুকুমনামা পাঠায়। ডিপুটি কমিশনার সেটা পাঠিয়ে দেয় পুলিশে আইজিকে।
উপরস্থ এসব সেনা কর্মকর্তা ও পুলিশ অফিসার ছিলো ইংরেজ। তখন চলছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
ইংরেজদের অবস্থান তখন খুব একটা সংহত ছিলো না। তাদের পক্ষে হিন্দুস্তানী সৈন্যরা বিভিন্ন ফ্রন্টে জানবাজি রেখে লড়ছিলো। এজন্য ইংরেজরা হিন্দুস্তানি সৈন্যদের সন্তুষ্ট রাখতে অনেক কিছুই করতো।
কোন মামুলি সিপাহীও যদি তার কমান্ডিং অফিসারকে দরখাস্ত দিতো যে, তার গ্রামে তার খান্দানের লোকরা অমুকের শত্রুতার শিকার। কমন্ডিং অফিসার সঙ্গে সঙ্গে ডিপুটি কমিশনারের মাধ্যমে সে এলাকার পুলিশ ইনস্পেকটরকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য হুকুম দিয়ে দিতো।
আমাদের ডিএসপিও তার উপরওয়ালের হুকুমেই এসেছেন। তিনি ইংরেজ হওয়ায় এক হিন্দুস্তানি সৈন্যের অভিযোগ দূর করতে কম আন্তরিক ছিলেন না। ডিএসপি সাহেব সাব ইনস্পেক্টরকে হুকুম দিলেন, এখনই অপহৃত সেই মেয়ের গ্রামে তদন্ত শুর করো।
তোমাদেরকে আমি কোর্ট মার্শাল করিয়ে ছাড়বো- ডিএসপি সাহেব জলদ গম্ভীর কণ্ঠে হুমকি দিলেন- শুধু পাঁচটা দিন সময় দিচ্ছি তোমাদেরকে। আমি সঠিক রিপোর্ট চাই। ঐ মেয়েকে অপহৃরণ করা হয়েছে, না সে নিজের ইচ্ছায় গিয়েছে। অপহরণ হলে রিপোর্টের সঙ্গে আসামীকেও হাজির করতে হবে।
ডিএসপি সাহেব আমাদের রক্ত পানি করে চলে গেলেন। আমরা ঠাকুর হত্যা মামলাসহ অন্যসব মামলার কাজ স্থগিত রেখে ঐ মেয়ের অপহরণ মামলার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
***
তদন্ত কাজে দুদিনের মধ্যেই আমাদের নাভিশ্বাস উঠে গেলো। যে গ্রামের যাকেই সামান্য সন্দেহভাজন মনে হতো তাকেই ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। মাত্র পাঁচ দিনের এত অল্প সময়ে একটা কেসকে সুরতহাল করার এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি আর হতে পারে না।
এ পদ্ধতি ছাড়া আমি আরেকটা পদ্ধতি বের করলাম। সেটা হলো, সারাক্ষণ আল্লাহকে স্মরণ করা। উঠতে বসতে আমি দরবারে এলাহীতে আর্জি জানাতে লাগলাম।
হে আল্লাহ! আমার ঈমানদারী ও আমানতদারীর সম্মান আপনি অক্ষুণ্ণ রাখুন। এই চ্যালেঞ্জে আমাকে সফল করুন। এই কেসের সঠিক সুরতহাল করে দিন। আল্লাহ তাআলা মনে হয় তার দয়ার সাগরে আমার আর্জি কবুল করে নিলেন।
তদন্তের তৃতীয় দিন। আমি ও আমার সাব ইনস্পেক্টর রাম সাহা মিলে গ্রামের এক তৃতীয়াংশ লোককে থানা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে গেছি। কিন্তু সে মেয়ের নাম ছাড়া আর কিছুই জানতে পারলাম না। মেয়ের নাম হলো দুলারী। ডিএসপির দেয়া সময় পাঁচ দিনের মধ্যে আর মাত্র দুই দিন বাকি আছে।
তৃতীয় দিনের সূর্য অস্তগামীর পথে। সাব ইনস্পেক্টর রাম সাহাকে দুলারীদের গ্রাম থেকে ফিরে আসতে দেখা গেলো। তার চাল চলনেই বুঝা যাচ্ছিলো, আজও সে ব্যর্থ হয়েছে।
তার মুখটি শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেছে। আমার সামনের চেয়ারে গা ছেড়ে দিয়ে এমনভাবে বসলো যেন সে পরাজয় মেনে নিয়েছে। তার এ অবস্থা দেখে আমার মুখ দিয়েও কথা সরছিলো না। এ সময় পোষ্ট অফিসের এক পিওন আসলো।
সে ভেতরে না এসে আমাকে বাইরে রেখেই ইশারায় ভেতরে ডাকতে লাগলো। প্রথমে আমি রেগে গেলেও মনে হলো সে যেন কিছু এটা বলতে চায় যা আমার জন্য জরুরী। মনে মনে বললাম, রাখো, তুমি যদি এছাড়া অন্য কোন সুপারিশ নিয়ে এসে থাকো তাহলে তোমাকেও সাইজ করে ছেড়ে দেবো।
আমি আপনার পোষ্ট অফিসের ডাক পিওন- আগন্তুক পিওন বললো আমি গ্রামে গঞ্জে পোষ্ট অফিস থেকে চিঠি বিলি করি। যে গ্রামের মেয়ে লাপাত্তা হয়েছে সে গ্রামেরও দশ বারটি চিঠি ছিলো আমার কাছে। আপনি জানেন, গ্রামের লোকেরা সাধারণত লেখাপড়া খুব একটা জানে না। তাই তাদের চিঠি আমাকেই পড়ে দিতে হয়।
আমি একটা চিঠি পড়লাম, এটা লিখেছেন এক হাবিলদার। লাপাত্তা হয়ে যাওয়া মেয়ের ভাই নায়েক জগমোহন যে জাট রিজিমেন্টে আছে ইনি সেই রেজিমেন্টেরই হাবিলদার।
হাবিলদার তার স্ত্রীকে লিখেছেন, নায়েক জগমোহনের বোন দুলারী তার বাসায় আছে। ঐ হাবিলদার বাড়িতে কিছু একটা পাঠাবেন। তিনি লিখেছেন, সে জিনিসটি দুলারীকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবো। হাবিলদার এও লিখেছেন, তিনি তার রেজিমেন্টের ফ্যামিলি কোয়ার্টারে দূর্গা নামের এক লোককেও দেখেছেন।
আমার কাছে মনে হলো, এই ডাক পিওন আকাশ থেকে নেমে এসেছে। না হয় আমি স্বপ্ন দেখছি। অথবা এ লোক মিথ্যা বলছে।
তুমি কি বাজে বকছো?- আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো- দুলারীর ভাই নিজেই তো দরখাস্ত দিয়েছে তার বোন দুলারী লাপাত্তা হয়ে গেছে। এটা কি করে বিশ্বাস করবো যে, সে তার বোনকে নিজের কাছে রেখেছে এবং তার বোন অপহরণ হয়েছে বলে তদন্তের দরখাস্ত করেছে,……… আর ঐ দুর্গাই বা সেখানে কি করছে?
আপনি স্যার হাবিলদারের ঘরে চলে যান- ডাক পিওন বললো- আমি জানি, দুলারী লাপাত্তা হয়ে যাওয়াতে গ্রামের ওপর কেমন বিপদ নেমে এসেছে। সে গ্রামে পুলিশের সাধারণ কোন কনস্টেবলকে দেখলেই লোকজন এদিক ওদিক পালাতে শুরু করে। হাবিলদারের বাপ হাত জোড় করে আমাকে বলেছে, আমি যেন কাউকে এই চিঠির কথা না বলি। তাহলে পুলিশ তাদের সবাইকে থানায় নিয়ে যাবে। তারপর মারপিট করবে…….