এরপর যারা অপেশাদার ছিলো তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করি। এরা সৌখিন জুয়াড়ি এবং এ পথে আনাড়ী। এখনো অন্য কোন অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়েনি। পুলিশের মুখোমুখিও এই প্রথম হয়েছে।
বড় বড় জমিদার ও জায়গীরদারদের ছেলে ছেলে ওরা। নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে পুলিশের সামনে পেটের সব কথা উপড়ে দেয়। ঠাকুরের কথাবার্তা এমন করে বললো যেন এরা তার দুশমন ছিলো। এরা আমার কিছু সন্দেহ দূর করলেও সেখানে নতুন সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছে।
কখনও মনে হচ্ছে আমার তদন্ত সঠিক ভাবে এগুচ্ছে। আবার কখনো মনে হচ্ছিলো আমি ভুল পথে যাচ্ছি।
হত্যার কারণ তো নারীঘটিত প্রেম প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হতে পারে। এই সূত্রে এক যুবতীর নাম উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে তার পরকীয়া পুরুষের নামও এলো। আরো দুই নর্তকীর নাম উঠলো। ঠাকুর এদেরকে কখনো কখনো বাগান বাড়িতে ডেকে আনতেন।
এদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে চার পাঁচ দিন কেটে গেলো। জিজ্ঞাসাবাদে এরাও আরো কয়েকজনের নাম সন্দেহভাজনের তালিকায় ঢুকিয়ে দিলো। এদের পেছনে আরো কয়কে দিন লাগলো।
এসব থেকে আমি উল্লেখযোগ্য কিছুই পেলাম না। দর্গারও কোন খোঁজ নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমি দুর্গার আকার আকৃতির বর্ণনাসহ অন্যান্য রিপোর্ট জেলার সমস্ত থানায় নিয়ে পাঠিয়ে দিলাম।
দুর্গার স্ত্রী ও বোনকে রাতের বেলা ওদেরকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম পুলিশ প্রহরায়। আর দিনের বেলায় থানায় এনে আটকে রাখতাম। এটা এজন্য করছিলাম যে, দুর্গা যদি জানতে পারে তার ঘরের যুবতী মেয়েদের এভাবে বেইজ্জতী করা হচ্ছে তাহলে সে নিজেই থানায় এসে আত্মসমর্পণ করবে।
দুর্গার বউ ও বোনকে কয়েকবার বলেছি, শুধু এটা বলো যে, ঠাকুর তোমাদের ইজ্জতের ওপর হাত উঠিয়েছিলো। তোমাদেরকে হয়রানি থেকে মুক্তি দেবো। ওরা তা অস্বীকার করেছে।
আমার সন্দেহ ছিলো, ওরা জানে যে, দুর্গা তার স্ত্রী ও বোনের বেইজ্জতীর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ঠাকুরকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছে।
ওদিকে মদের বেতাল ও গ্লাসের ওপর আঙ্গুলের ছাপের রিপোর্ট ইলাহাবদ থেকে চলে এসেছে। অন্যদিকে ঠাকুরের পোষ্টমর্টেমের রিপোর্টও এসে গিয়েছিলো।
এতে সত্যায়ন করা হয়েছে, নিহত ব্যক্তিকে বিষয় দেয়া হয়েছিলো। থানায় ও থানার বাইরে যাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম তাদের হাতের ছাপ আগেই নিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু কারো হাতের ছাপের সঙ্গেই বোতল ও গ্লাসের ছাপের মিল খুঁজে পেলাম না। অর্থাৎ এখনো আমরা ঠাকুরের হত্যাকারীর কেশও স্পর্শ করতে পারিনি।
তদন্ত কাজে শহর থেকে বিশ মাইল দূরের এক গ্রামেও যেতে হয়েছিলো। সেখানে ঠাকুরের কাছে আসা যাওয়া ছিলো এমন দুই নর্তকীর জবানবন্দি নিতে হয়েছিলো। তাদের পেছনে আরো তিন দিন নষ্ট করি। কিন্তু লাভের খাতা এখানেও শূণ্য।
তবে পাওয়া গেছে এতটুকু যে, এখন যাকে খুঁজে বের করতে হবে সে হলো দূর্গা। অন্যান্য পুলিশ অফিসাররাও বলেছে, দুর্গা সাধারণ কোন অপরাধী নয়, তার হাত অনেক লম্বা।
***
বাইশ তেইশ দিনের ঘটনা। ঠাকুর হত্যার তদন্ত কাজ আগের জায়গাতেই ঝুলে আছে। হঠাৎ এক দিন আমাদের ওপর মুসিবত নেমে এলো। আমাদের ইংরেজ ডিএসপি থানায় এসে হাজির।
ডিএসপি ও এসপিরা এভাবেই কোন না কোন থানায় এসে হাজির হয় এবং চলতি তদন্তনাধীন মামলার ফাইল ঘেটে দেখেন, থানা পুলিশরা ঠিক মতো কাজ করছে কিনা। তখন বিশেষ করে ইনস্পেক্টরদের বারোটা বাজিয়ে ছাড়েন।
অবশ্য মাঝে মধ্যে তারা খোশ মেজাযেও আসেন এবং থানা ও এর আওতাধীন এলাকা পরিদর্শন করে চলে যান।
কিন্তু এবার ডিএমপি এলেন ভিন্ন উদ্দেশ্যে। তিনি এসেই নিহত ঠাকুরের গ্রামের কথা বলে বললেন,
সেখান থেকে যে এক মেয়ে গায়েব হয়ে গিয়েছিলো তার ফাইলটি বের করো ……..
ঐ মেয়ের বাবাকে থানায় নিয়ে এসেছিলো এই নিহত ঠাকুর। ঐ কেস আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। তাই এর তদন্তভার দিয়েছিলাম আমার জুনিয়র সাব ইনস্পেকটরকে।
ঠাকুর তখন বলেছিলো, ঐ মেয়েকে কেউ অপহরণ করেনি, মেয়ে নিজেই কোথাও চলে গেছে। আমার ধারনাও ছিলো তাই। এর দুই তিন দিন পরই ঘটে ঠাকুরের বিষ প্রয়োগে হত্যার ঘটনা। আমি তখন এই মামলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
ডিএসপি সাহেব ফাইল দেখলেন। সাব ইনস্পেক্টর এই ফাইলে অনুমান নির্ভর কিছু কথা লিখে ফাইল তাকবন্দি করে রেখেছিলো।
ডিএসপি চোখ গরম করে বললেন, এক মাসে এতটুকু তদন্ত হয়েছে?
আমরা মাথা নিচু করে রাখা ছাড়া কোন জবাব দিতে পারলাম না।
ডিএসপি খাস গাইয়া ভাষায় আমাদেরকে অনেক গালাগাল করলেন। এই ভাষা কোত্থেকে যে তিনি শিখেছেন আল্লাহই ভালো জানেন।
চাবুক মারার মতো ভাষায় বললেন, তোমরা এই মামলাকে শুধু এ কারণে ফাইল চাপা দিয়ে রেখেছো যে, অপহৃত মেয়ে এক গরিব বাপের মেয়ে। তোমরা সেসব মামলাতেই আগ্রহ পোষণ করো যেগুলোর তদন্ত করতে গিয়ে তোমরা খাতির যত্ন পাও।
তোমরা থোকাবাজ। বেঈমান হিন্দুস্তানি- তিনি বললেন।
ডিএসপি জানালেন, অপহৃত ঐ মেয়ের বড় ভাই ফৌজে ল্যান্স নায়েকের পদে আছে। সে তার বোনের হারিয়ে যাওয়ার খবর জানতে পারে তার বাবার প্রেরিত চিঠি মাধ্যমে।
চিঠিতে তার বাবা একথাও লিখে যে, এই মামলার তদন্তের ব্যপারে পুলিশের মোটেও আগ্রহ নেই।