তাছাড়া আমরা মনে করতাম, দিল্লির চেয়ে দূরের আর কোন জায়গা নেই। শুধু জানতাম দিল্লি মুসলমানদের শহর। কি কারণে জানি আমারও মনে হলো দিল্লি ছাড়া আর কোথাও আমাদের আশ্রয় মিলবে না…..
গাড়ি পৌঁছতে এখনো দু ঘন্টা বাকি আছে। অন্ধকার এক কোনে গিয়ে আমরা বসে পড়লাম। তামীমা এখন আমার চেয়ে অনেক সাহসী মেয়ে। আমাকে এটা সেটা বলে সাহস বাড়াতে লাগলো।
দিল্লিতে কিভাবে যাওয়া যায়, কি করে দিল্লি চিনবো এক ফাঁকে এটা জিজ্ঞেস করে নিলাম এক লোকের কাছ থেকে। চিন্তিত ছিলাম পথে আবার গাড়ি পাল্টাতে হয় কিনা।
লোকটি জানালো, চিন্তা নেই এই গাড়ি সোজা দিল্লি যাবে, পরদিন দুপুরে গিয়ে পৌঁছবে।…… গাড়ির সময় হলে দুটি টিকেট কেটে নিয়ে এলাম। তখন গাড়িতে এত ভিড় হতো না। বিশেষ করে রাতে গাড়ির কম্পার্টমেন্ট খালি যেতো। আমরা নিরালা একটা কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়লাম……
গাড়ি আমাদেরকে এক বিপদ থেকে উদ্ধার করে অজানা এক গন্তব্যের দিকে নিয়ে চললো। যে গন্তব্য সম্পর্কে কোন জ্ঞাণই ছিলো না। অজানা সেই দেশে পৌঁছে গেলাম। গাড়িতে আর কোন ধরনের ঝামেলা হয়নি।
এত বড় স্টেশন দেখে তো আরো ঘাবড়ে গেলাম। মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। যে দেশের রেল স্টেশন এত বড় সে দেশটা না জানি কত বড়।
এত বড় শহরে আমরা কোথায় যাবো, আল্লাহ তাআলা আমাদের সাহায্য করলেন। স্টেশনে দাঁড়িয়ে দুই আনাড়ী যুবক যুবতী যখন কোথায় যাবো না যাবো এই ভেবে অস্থির হয়ে পড়ছিলাম, তখনই আল্লাহর এক বান্দা এগিয়ে এলো……..
***
এ যেন আল্লাহর পাঠানো ফেরেশতা। আমাকে দেখে হয়তো আচ করে নিয়েছিলো, এরা এই শহরে নতুন এবং অসহায়। আর আমার বউ তামীমাকে দেখে হয়তো আশংকা করেছে এত সুন্দরী মেয়েকে এই লোক এত বড় শহরে বড় বিপদে পড়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না।
লোকটি নেক দিলের মানুষ ছিলো। আমি তাকে বললাম, রোজগারের তালাশে দিল্লিতে এসেছি। জানি না, লোকটির মনে কেন এ সন্দেহ জাগলো না যে, আমি কোন সন্দেভাজন লোকও হতে পারি।
আর এ মেয়ে আমার স্ত্রীও না হতে পারে। লোকটি আমাদেরকে তার বিরাট বাংলোয় নিয়ে গেলো। বাংলোটির মালিকদের সামনে আমাদের হাজির করলো। বড় বড় দুটি বাগান আছে সে লোকের। মহিষও আছে গোটা কয়েক……
তার এ ধরনের লোকের প্রয়োজন ছিলো, যে তার বাগান আরো সুন্দর করে গড়ে তুলবে এবং মহিষগুলোরও রাখালি করবে। আগে যেসব মালি ও নওকর ছিলো তারা হয় পালিয়ে গেছে না হয় কাজ না বোঝার কারণে বাদ পড়েছে। আমি দেহাতী বলে আমাকে পছন্দ করলো মালিক। বাংলোর সঙ্গে আমাদেরকে দু রোমের কোয়ার্টারও দিয়ে দিলো………..
আজো যখন সেই স্মৃতির পাতা উল্টে দেখি। আমার কাছে মনে হয় এসব কিছুই ঘটেনি। অনেক দিন ধরে আমি কল্পনার জগতে স্বপ্নের রঙ্গীন পাতা দিয়ে সাজিয়েছি এসব।
এতো এক ধরনের কারামতই ছিলো, পরদেশে পা রাখলো একজন লোক আর তাকে আরেকজন এমনভাবে আশ্রয় দিলো যেন খোদা তাকে আমার অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো। কোন পূণ্য কাজের পুরস্কার খোদা দিয়েছিলেন এটা? এমন কোন পূণ্যের কথা তো আমার স্মরণে পড়ে না। আমি তো পাক্কা পাপী ছিলাম। তার ওপর ছিলাম কামিন–নিকৃষ্ট জাতের ইতর লোক……
বাগানের দায়িত্ব নিয়ে নিলাম আমরা। আর মহান আল্লাহর দরবারে মাথা ঝুঁকিয়ে দিলাম। তাছাড়া যেহেতু সেখান থেকে আমাদের আর পালানোর প্রয়োজন ছিলো না, আমরা পালিয়ে কোথাও যেতেও পারতাম না; তাই মন প্রাণে ঢেলে দিলাম বাগানের পেছনে। দুজনে মিলে বাগানটাকে দারুণ সুফলা করে তুললাম।
এ যেন আমাদের নতুন জীবনের চ্যালেঞ্জ। অল্প দিনের মধ্যেই ফল ফলাদি ও সবজির এত প্রচুর ফলন শুরু হলো যে, প্রতিদিন আমি কয়েক গাড়ি সজি ফল বাজারে নিয়ে যেতাম আর মুঠি মুঠি পয়সা নিয়ে ফিরে আসতাম। সঙ্গেসঙ্গে যত্নআত্নি করে মহিষগুলোকে তাজা করে তুললাম…….
মালিক তো দারুন খুশি আমাদের কাজে। যেমন অভিজাত বংশের ছিলো তারা, তেমনি ভদ্র ও সজ্জনও ছিলো। আমাদের দুজনের সরল নিয়ত ও কঠোর পরিশ্রম দেখে তাদের পরিবারের মধ্যে আমাদেরকে গণ্য করে নিলো। আমরা শুধু নামকাওয়াস্তে ছিলাম নওকর।
তামীমার শুধু রূপই ছিলো না। বাইরের রূপের মতো ভেতরটাও ছিলো রূপময়- দারুণ কোমল। হাজারো খেটে মুখে ভুবন ভুলানো হাসিটা ঠিকই ধরে রাখতে পারতো।
মালিকের পরিবারের নারী মহলে তামীমা হয়ে উঠলো সবার নয়নের মনি। মালিকের স্ত্রী বলো, আমার মেয়ে বলো, অন্যকোন আত্মীয় স্বজন বললো, তামীমার নামে সবাই পাগল। তামীমাকে ছাড়া তাদের কোন গল্পের আসরই জমে না……..
একটু চিন্তা করে দেখো তো, এতবড় ঘরনীর মেয়ে। অথচ সাধারণ এক কামিনের ভালোবাসার টানে নওরের জীবন বেছে নিয়েছে। নিজেও কামিন বনে গেছে। তারপরও বাধ্য হয়ে নয়, হাসি মুখে।
কোন অনুযোগ করেনি কোন খাটুনির জন্য। অভিমান করেনি এই জীবনের জন্য। এদের সঙ্গে আমরা এমনভাবেই মিশলাম যে, তামীমা গল্পে গল্পে আমাদের ফেলে আসা অতীত কাহিনী শুনিয়ে দিলো……..
এভাবে দুই বছর পার হয়ে গেলো।
বাংলোর মালিক আমাকে ডেকে বললো, ঘর থেকে জানতে পেরেছি, তোমার স্ত্রী এক আমীর পরিবারের মেয়ে। আশ্চর্য, এমন উঁচু ঘরের মেয়ে কি করে এত কষ্টের কাজ করে যাচ্ছে। সত্যিই না দেখলে বিশ্বাস হতো না।