বললো- আরে কামিন! এই তোমার ভাগ্য? এতো এই গদির বরকত। আমাদের খেদমত করে যাও এবং আয়েশও করে যাও আরো বেশি করে।
তামীমার মাথা ও গালে হাত বুলিয়ে দিলো এবং আমার দিকে আজব চোখে তাকিয়ে রইলো….
তামীমা খুব ঘাবড়ে গেলো। আমার দুহাত খামচে ধরে বললো, এখানে আর একদিনও থাকা ঠিক হবে না। এতো এর বাপের চেয়ে বড় বদমায়েশ মনে হয়। পীরজাদা সেদিনই তার মনের বদমায়েশি রূপ দেখিয়ে দিলো।
জোয়ান হওয়াতে বাপের চেয়ে বেপরোয়াও ছিলো বেশি। তাছাড়া সারা এলাকার লোকেরা তাকে পীর বলে মেনে নিয়েছে।
সে আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বললো- ঐ মেয়েদের বাড়িতে এখান থেকে বেশি দূরে নয়। ওদের সারা খান্দান আমাদের মুরিদ। ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু মেয়ের হাওয়াও আমরা বাইরে যেতে দেবো না। ভয় পেয়ো না, শুধু এটা খেয়াল রাখবে যে, ওকে শুধু নিজের বউ মনে করো না। তোমার পীর মুরশিদের দিকেও খেয়াল রেখো…….
মাথায় আমার আগুন জ্বলে উঠলো। কিন্তু আমি নিজেকে কঠিনভাবে শাসন করলাম। বহু কষ্টে শান্ত রাখলাম নিজেকে। আর পীরজাদার সামনে বিগলিত হয়ে বললাম,
আমরা সরকারের মাজারের গোলাম। এমন কথা বলারই বা কি প্রয়োজন। আমার সবকিছুই আপনার জন্য উন্মুক্ত।
সে খুব খুশি হলো। তাকে বললাম, আমার কিছু টাকা-পয়সা দরকার। এই বলে দুশ টাকা চাইলাম। সে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিলো। তখন দুশ অনেক টাকা। বড় বড় সরকারি অফিসারের বেতনই ছিলো ত্রিশ টাকার নিচে। তামীমার কাছেও বেশ কিছু টাকা ছিলো……
রাতে যখন পীরজাদা শরাব খেয়ে মাতাল হয়ে তার ছোট সতালো মায়ের ঘরে চলে গেলো। খাস মুরিদরাও যার যার ডেরায় ফিরে গেলো, তামীমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমি। এমন এক সফরে বেরিয়ে পড়লাম যার মনযিল জানা ছিলো না আমার।
এখন তো আমরা দুজনই সবার চোখে আসামী। মনযিল তাই মৃত্যুও হতে পারে। ছিলাম আমি গোঁয়ার গ্রাম্য। দেহাতের বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে কিছুই জানতমা না। আমরা পায়দল যাচ্ছিলাম রেল স্টেশনের দিকে। সেখান থেকে চার মাইল দূরে রেল স্টেশন। চাঁদনী রাত ছিলো। ক্ষেত খামারের ভেতর দিয়ে পথ করে চলছিলাম আমরা……..
কয়েকবার আমি পিছন ফিরে তাকালাম। মাজারের গম্বুজটি চোখে পড়লো আমার। বহু দূর থেকে সেটি দেখা যায়। মানুষ তো একে কাবা শরীফ মনে করে। একে সিজদা করে। মান্নত মানে। সিন্নী করে।
কে তাদেরকে বলবে, এ গদি আসলে বদকারদের নোংরা আড়া। এখানে কারো বোন, মেয়ে ও স্ত্রীর আবরু নিরাপদ থাকে না। এখানে কোন জিনও বন্দি নেই। কয়েকজন খাস মুরিদই এখানকার জিন।
পীরকে কোন জিন হত্যা করেনি। হত্যা করেছে কোন মানুষ। ভেবে দেখো তো, যদি লোকদেরকে বলে দিতাম, আসল জিন আমি ও আমার চার সঙ্গী। তাহলে কি কেউ এটা বিশ্বাস করতো? তুমি লোকদেরকে আমার কাহিনী শুনিয়ে দেখো, বলবে, ভূয়া গল্পবাজ লোক…….
***
যুগ আজ কত উন্নতির পথে এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের লোকেরা আজো পীরের পায়ে সিজদা করে। এখনো মাজারে গিয়ে মাথা ঠুকে। তাদের স্ত্রী, বোন, মেয়েরা পীরের খাস কামরায় গিয়ে নিজেদেরকে নযরানা হিসেবে পেশ করে…….
যে মাজারে সালাম করার জন্য লোকেরা লম্বা লম্বা সফর করে আসে, সেই মাজারের ওপর শত অভিশাপ দিয়ে আমি আরো ভয়ংকর সফরে বের হয়ে পড়েছি। আমার আসল পীর মুরশিদ তো ছিলো আল্লাহ ও তার রাসূল (স)-এর পবিত্র জাত। অন্তরে তাদের নামই স্মরণ করছিলাম।
আমিও পাপ করেছিলাম। একেবারে নিষ্পাপ ছিলাম না। তামীমার স্বামী জীবিত থাকতে ওকে আমি বিয়ে করি। অথচ তার স্বামী তাকে তালাকও দেয়নি।
আমার মূর্খ মাথায় একবার একথাও এলো না যে, তামীমাকে নিয়ে আমি ওদের গ্রামে যাই। সবার সামনে ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে বলে উঠি, এই যে দেখে নাও তোমাদের ইযযত, অহংকার, জাতপাতের রাজনীতিকে এক কামিনের পায়ে আছড়ে ফেলেছে।
ঐ উঁচু জাতের ভূরি ওয়ালারা তো একেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব মনে করে যে, নিজের স্বামীর বাড়ি থেকে মেয়েকে এনে ঘরে বসিয়ে রাখা। আর স্বামীও শ্বশুরালয় থেকে স্ত্রীকে উঠিয়ে আনাকে নিজের বেইজ্জতি মনে করে……।
আরো বলতাম, তোমরা তার দেহ মন আর যৌবনের দিকে তাকাওনি। তাকিয়েছো নিজেদের মিথ্যা অহংকারের দিকে। এ কারণে মেয়ে মনের ও দেহের তৃষ্ণা মেটাতে তার পছন্দ মতো একজনকে বেছে নিয়েছে……
কত চিন্তা যে মাথায় এলো। সবই উদ্ভট চিন্তা। নিজের পরিণাম সম্পর্কে তো জ্ঞানই ছিলো না। খোদার কাছে আমি মাফ চাইলাম। তার কাছে সাহায্য চাইলাম। একটু কান্নাও করলাম মুখ লুকিয়ে। তামীমা বুঝতে পারেনি।
মোটেও আশা করিনি খোদা আমাকে মাফ করবেন। কারণ, আমি জানতাম কত বড় পাপী ছিলাম আমি। জেনে শুনে পাপ করে ছিলাম আমি…..
তারপরও ভরসা ছিলো ঐ মহান সত্ত্বার ওপরেই। রাত থাকতেই আমরা ষ্টেশনে পৌঁছে গেলাম। তামীমা মুখ ঢেকে রেখেছিলো চাদর দিয়ে। আমি মাথা মুখ চাদর দিয়ে আবৃত রেখেছিলাম।
কোথায় গেলে সুবিধা হবে তা তো জানতাম না। তামীমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো- দিল্লির টিকেট কেটে ফেলো।
দিল্লি তো আমিও চিনি না, তামীমাও না। কখনো কেউ দিল্লি যাইনি আমরা। আসল কাজ হলো এখন যত দূরে চলে যাওয়া যায়। এখানে বসে থাকাটা বিপজ্জনক।