পীর তার কথা রাখলো। পীরের বাড়িটি বিশাল ছিলো। আমাকে এমন একটি কামরা দেয়া হলো যেখানে আমরা ছাড়া আর কেউ যাবে না। পরদিন আমাদের বিয়ে পরিয়ে দিলো। কালেমা পড়িয়ে নিজেই সাক্ষী হলো। নিজেই। কাজী হলো…..
যদি জিজ্ঞেস করো, আমার পরবর্তী পরিকল্পনা কি ছিলো? তোমাকে জবাব দিতে পারবো না আমি। তখন ছিলো উন্মুক্ত যৌবনের তাপ। তামীমার প্রতি নিখাদ ভালোবাসার তীব্রতা আমাকে চিতার শক্তি আর সাহস দিয়েছিলো। কিন্তু বুদ্ধির ঘর ছিলো অন্ধকার।
আমার ভাবনা বলো চিন্তা বলো একটাই ছিলো। এত বড় ঘরের এমন সুন্দরী মেয়ে আমার জন্য ঘর ছেড়ে চলে এসেছে, আর আমার মতো এমন বীর যুবক তাকে উপেক্ষা করবে। তাছাড়া পীর আমার মনোবল এই বলে আরো বাড়িয়ে দিলো যে
চিন্তা করো না, আরামে থাকো, এখানে তোমাদেরকে জিনও দেখতে পাবে না……
পরদিনই তামীমার মা পীরের কাছে এসে হাজির। আমরা তো জানতামই কেন এসেছে মহিলা। পীরকে এসে জানালো, তার মেয়ের স্বামী আত্মহত্যা করেছে। তামীমাকে তার পূর্ব স্বামীর আত্মহত্যার খবর জানালাম আমি। কোন প্রতিক্রিয়া হলো না তার।
ঘটনা দুঃখজনক হলেও আমি একটু ভারমুক্ত হলাম যে, এই মেয়ে আমার জন্য এখন সম্পূর্ণ বৈধ হয়ে গেছে।
পরে পীর আমাকে বলেছিলো, তামীমার মা এই প্রার্থনা নিয়ে আসে যে, জিনদের জিজ্ঞেস করে দেখুন, আমার মেয়ে কোথায় আছে? পীর মহিলাকে বলেছিলো, এখনো জানা যায়নি কোথায় গেছে। শুধু এতটুকু জানা গেছে যে, সে নিজ ইচ্ছায় গিয়েছে। একাধারে পাঁচ ছয় দিন মহিলা পীরের দরবারে হাজিরা দিলো……
***
তামীমাকে আমি এ কয়দিন লুকিয়ে রাখলাম। সাত দিনের দিন তো কেয়ামত এসে গেলো। ঘুম থেকে উঠেই শুনি পীর তার কামরায় মরে পড়ে আছে। আমি গিয়ে লাশ দেখলাম।
চিত হয়ে পীর পড়ে আছে সে কামরায় যেখানে জিনদের হাজির করা হতো। চোখ দুটি খোলা।
আগুনের মতো সারা এলাকায় খবর ছড়িয়ে পড়লো, তাদের পীর মুরশিদ কতল হয়ে গেছে। মুরিদরা পিল পিল করে তার আস্তানার দিকে আসতে লাগলো। হাজারো মুরিদ জমা হয়ে গেলো অল্প সময়ের মধ্যে। দেখলাম সবাই ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। মেয়েরাও কাঁদছে চিৎকার করে……..
আমার ভয় হলো, তামীমাকে না আবার কেউ দেখে ফেলে। তাই যে কামরায় ওকে লুকিয়ে রেখেছিলাম সে কামরার বাইরে থেকে পুরনো একটি তালা ঝুলিয়ে দিলাম। কাঁদছিলো তো সবাই।
কিন্তু পীরের ছেলে ছিলো ব্যতিক্রম। তার চোখ দুটো ছিলো শুকনো। আরেকজন হলো পীরের হোট স্ত্রী। সেজেগুজে আস্তানার এক কোনে শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। পীরের ছেলে কয়েকবার লোকজনের ভিড়ে গিয়ে বলে আসলো, এ হলো জিনদের কারসাজি………
বেলা চড়ার আগেই পুলিশ এসে গেলো। পুলিশ অফিসারের কাছেও পীরের ছেলে বললো, আপনারা সময় নষ্ট করবেন না। তদন্ত করে কিছুই পাবেন না। কারণ, পীরদেরকে কোন মানুষ হত্যা করতে পারবে না। এটা জিনদের কাজ। আমার বাবার কজায় বড় বড় অবাধ্য জিন ছিলো। এ ধরনের কোন এক জিন কজা থেকে বেরিয়ে গেছে। তারপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তাকে হত্যা করেছে……
পুলিশ অফিসার ছিলো হিন্দু। সে অনেক জেরা করলো মুরিদদেরকে। ভেতরে পীরের ছেলের সঙ্গে অনেক্ষণ কাটালো। লাশ ভেতরেই ছিলো।
সবাই জানতত, লাশ পোষ্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু পীরের লাশের সঙ্গে কোন বেয়াদবীমূলক কিছু হবে এটা কেউ পছন্দ করছিলো না। তারপরও পুলিশের দায়িত্ব তো পালন করতেই হতো। তিন চার ঘন্টা পর ইনস্পেক্টর বাইরে এলো এবং কনস্টেবলদের নিয়ে থানায় ফিরে গেলো…
লাশ কামরায় খাটের ওপর শোয়ানো ছিলো। সেভাবেই পড়ে রইলো। ওদিকে পীরের ছেলে ঘোষণা করিয়ে দিলো, তার পিতার মৃত্যু জিনদের হাতে হয়েছে। মুরিদদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়লো।
পীরের ছেলে আরেকটা কাজ করলো। খাস মুরিদদের মাধ্যমে রটিয়ে দিলো যে, সে তার বাবার সমস্ত জিনকে নিজের কজায় নিয়ে নিয়েছে এবং তার বাবার ঘাতক জিনকে যেভাবেই হোক ধরে এনে হত্যা করা হবে……
পীরের লাশকে আমি ও তার এক খাস মুরিদ মিলে গোসল দিলাম। কাফনও পরালাম। তারপর বড় শান শওকতের সঙ্গে জানাযা অনুষ্ঠিত হলো। যেখানে তার বাবা পীরের কবর সেখানেই তাকে দাফন করা হলো। এতে মাজারের মর্যাদা আরো বেড়ে গেলো। কারণ; এই মাজারে এখন দুই জন পীর কবরস্থ হয়েছে……….
আমার আবার ভয় হলো, তামীমা না আবার ধরা পড়ে যায়। পীরের ছেলে এটা জানতো না যে, এই বাড়ির এক কামরায় আমি একটি মেয়েকে লুকিয়ে রেখেছি। সে শুধু জানে, আমি ওর বাপের খাস মুরিদদের একজন ছিলাম। ছেলেরও এ ধরনের মুরিদের প্রয়োজন আছে।
সে আমাদেরকে তার ইয়ার বন্ধুদের দলে ভিড়িয়ে নিয়ে তার বাপের বড় স্ত্রীকে পৃথক একটি বাড়ি দিয়ে দিলো। আর ছোট স্ত্রীকে নিজের সঙ্গে রেখে দিলো। দুজনই ছিলো তার সলো মা।
ছোট স্ত্রী তার সমবয়সীই ছিলো। একে নিয়ে বাপ বেটার মধ্যে কথাবার্তাও বন্ধ ছিলো। ছোট স্ত্রী নিজেই পীরের ছেলেকে পছন্দ করতো। তা ছাড়া পীরজাদা তখনো বিয়ে করেনি……
যা হোক একদিন আমি ওকে বলে দিলাম, তাদের বাড়ির এক কামরায় তার বাপের অনুমতিতে এক মেয়েক লুকিয়ে রেখেছি। সে মেয়ে আমার জন্য ঘর ছেড়ে চলে এসেছে। তখন তার বাপ আমাদের বিয়ে পরিয়ে দিয়েছে। পীরজাদা মেয়ে দেখতে চাইলো। আমি তাকে সে কামরায় নিয়ে গেলাম। তামীমাকে দেখে তার মুখের হাসি চওড়া হয়ে গেলো।