অর্থাৎ ও বলছিলো, উঁচু জাতের মেয়েরা কামিন ছেলেদেরকে নিজেদের হেফাজতের জন্য নিয়ে যায়…… আমরা পীরের আস্তানায় পৌঁছে গেলাম। আর তামীমা বানু মিশে গেলো মেয়েদের সঙ্গে……….
পীরের ওখানে যাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিলো, ওদের সঙ্গে এবং পীরের সঙ্গে গভীরভাবে মেলামেশার কারণে পীরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেকটা ইয়ার দোস্তদের মতো হয়ে গেলো। মনে হতো, তিনি পীর নন আর আমি মুরিদ নই।
আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, দাগী গুণ্ডা, বদ মায়েশ ও অপরাধীদেরকে পীর তার আস্তানায় আশ্রয় দেয়। অপরাধীদের জন্য এ জায়গাটা নিরাপদ………
তবে পীরের জিন হাজির করার কারামতকে আমি সত্য বলে বিশ্বাস করতাম। চার পাঁচবার আমি তার এই কামালিয়াত দেখেছি। প্রথমবার তো ভয়ে আমার কলজে শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে ছিলো।
এক রাতে এক লোককে আনা হলো, তাকে জিনে ধরেছে। সঙ্গে তার পাঁচ সাতজন আত্মীয়ও ছিলো। পরে তাকে পীরের খাস বৈঠকে বসা হলো। জিনে ধরা লোকের আত্মীয়রা ও কয়েকজন মুরিদ সেখানে ফরশের ওপর বসা ছিলো। পীর বসা ছিলেন গালিচার ওপর। তার পেছনে উঁচু উঁচু মখমলের তাকিয়া।
প্রথমে পীর বিড় বিড় করে কি যেন পড়লেন। তারপর উঁচু আয়াজে বললো, এসো, এক্ষুনি এসো। আমি দেখতে চাই তুমি কে?….
চাপা ঝনঝনানির আওয়াজ উঠলো। আমি কামরার সব দিকে তাকালাম। সেখানে যারা ছিলো সবার মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়লো। ঘুঙ্গুর ধ্বনির সঙ্গে এবার কারো কান্নার আওয়াজ শোনা গেলো।
একবার সন্দেহ হলো, শব্দ আসছে পীরের পেছন থেকে। আমি বসা ছিলাম, পীরের গদির তাকিয়ার পেছনে। তাই সবই দেখতেও পাচ্ছিলাম। যাকে জিনে ধরেছে সে হেচড়াতে হেচড়াতে একদিকে সরে গেলো। তার পুরো দেহ কাঁপতে লাগলো………..
পীর জিজ্ঞেস করলেন- তুমি কোত্থেকে এসেছো?- আওয়াজ এলো- ওর দোকানের ওপর আমার আস্তানা।
পীর জিজ্ঞেস করলেন- কী দোষ করেছে সে?
আওয়াজ এলো- সে আমার মাথার ওপর পা রেখেছিলো।
পীর প্রশ্ন করছিলেন আর শূন্য থেকে এভাবে জবাব আসছিলো। এটা সবাই জানে, জিনরা যখন চলা ফেরা করে তখন নাকি ঘুঙ্গুর বাজার আওয়াজ হয়। কামরায় ঘুঙ্গুর বাজার শব্দ হচ্ছিলো। তারপর পীর ঐ জিনে ধরা লোকের সঙ্গে এবং খোদ জিনের সঙ্গে কি আচরণ করেছিলেন সে এক লম্বা কাহিনী। এভাবে চার পাঁচবার জিনের শব্দের মুখোমুখি হয়েছি আমি………
এরপর তো আমি নিজেই জিন বনে গেলাম। পীরের খাস মুরিদদের মধ্যে আমার স্থান হয়ে গেলো। আমি নিজেই ঘুর বাজাতাম এবং জিনের ভাষায় কথা বলতাম।
আমার মতো বলশালী ও সাহসী লোকের প্রয়োজন ছিলো পীরের। তার কাছে এ ধরনের চারজন মুরিদ ছিলো। আমি হয়ে গেলাম পাঁচ নম্বর……..
ভেদের কথা হলো, পীর যেখানে বসতেন, এর পেছনে একটি গর্ত খোদাই করা ছিলো। সেখানে বড়সড় একজন লোক বসতে পারতো অনায়াসে। সাক্ষাত প্রার্থীদের ঐ কামরায় ডাকার পূর্বে ঐ গর্তের ভেতর একজন গিয়ে বসে পড়তো। তখন গর্তের ওপর মোটা পাতের ঢাকনি দেয়া হতো।
এর ওপর বিছানো হতো গালিচা।
তারপর মুরিদ আর সাক্ষাতপ্রার্থীদের ভেতরে আসার অনুমতি মিলতো। পীর সাহেব যখন জিনকে ডাকতেন তখন গালিচার নিচ থেকে ঘুঙ্গুর বেজে উঠতো। আর সে লোক এমন শব্দে ও সুরে কথা বলতে যেটা পুরুস্বালী ও মেয়েলী কণ্ঠের মাঝামাঝি সুর হতো। আবার একটু নাকা নাকাও হতে…..
এর আগে আমরা জিনে ধরা ব্যক্তিদের বাড়ি ঘর দেখে আসতাম। ঘরের লোক কজন, সে কি করে, ছেলে মেয়ে কজন, প্রত্যেকের ব্যাপারে যতটুকু জানা যায় ইত্যাদি জেনে আসতাম। তারপর সে অনুযায়ি কথা বলতাম। লোকে শুনে তো তাজ্জব হয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলতো। আরে এসব জানলে কোত্থেকে?…
***
একটা ঘটনার কথা তোমাকে বলি আমি। সারা ড্রামা তুমি বুঝতে পারবে। এক মহিলা তার স্বামীকে চাইতো না। আবার স্বামী থেকে তালাকও নিতে পারছিলো না। অর্থাৎ মহিলা সুন্দরী হওয়াতে স্বামী তাকে তালাক দিতে চাচ্ছিলো না। অন্য এক লোকের সঙ্গে মহিলার গোপন প্রেম ছিলো।
তিন বছর ধরে তাদের দাম্পত্য জীবন চলেছে এভাবেই। মহিলা পীরের কাছে এসে বললো, তাকে যেন এমন একটি তাবিজ দেয়া হয় যাতে তার স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয়……
পীর মহিলাকে তাবিজ না দিয়ে অন্য একটা সবক দিলো। সবক অনুযায়ি মহিলাকে জিনে ধরলো। মহিলা জিনে ধরার এমন অভিনয় করলো যে, স্বামী বাড়ির লোকেরা ভয়ে আতংকে পীরের কাছে দৌড়ে এসে, বললো ইয়া সরকার। আমাদের বউকে বাঁচান।
পীর তাদেরকে এটা তাবিজ ও কিছু আমল দিয়ে বিদায় করে দিলেন। ওদিকে মহিলাও পীরের সবক অনুযায়ী জিনে ধরা ছদ্মবেশ ধারণ করে অভিনয় চালিয়ে গেলো। অবশেষে তার স্বামীর বাড়ির লোকদের জানানো হলো, অমুক দিন জিনকে হাজির করা হবে…….
তারপর পীরের খাস কামরায় জিনকে হাজির করা হলো। মহিলার স্বামী ও তার আত্মীয়স্বজনরা জিনের ঘুঙ্গুর বাজার গম্ভীর ধ্বনি শুনে ভয়ে কেঁপে উঠলো। সেই জিন কে ছিলো জানো? আমি ছিলাম।
পীরের গালিচার নিচে বসে ঘুঙ্গুর বাজিয়ে বাজিয়ে এবং পীরের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে হুমকি দিলাম, তার স্বামী যদি তাকে তালাক না দেয় তার পুরো বংশ ধ্বংস করে দেবো। তারপর ওকে আমি নিজেই বিয়ে করে ফেলবো,
গ্রামের লোকেরা আজ শিক্ষিত হয়েও এসব ভাওতাবাজিতে বিশ্বাস করে। আর তখনকার দিনে গ্রামে তা দূরের কথা শহরেও শিক্ষিত লোকজন খুঁজে পাওয়া যেতো না।