সুরেলা কণ্ঠের সঙ্গে যদি আবেগ মধিত শব্দ ছন্দের সঙ্গীত হতে মেয়েরা তো তখন পাগলপারা হয়ে যেতো। দেখবে, ছিনেমার গান যত ভালোই হোক, মানুষ বেশিক্ষণ শুনতে পারে না। কিন্তু ওয়ারিস শাহের মতো প্রাচীন সঙ্গীত-কলার ক্ষেত্রে আজো মানুষের আকর্ষণ কমেনি……..।
সেটা ছিল আসলে পৌরুষদীপ্ত যুগ। দামী পোষাকের চেয়ে সুগঠিত স্বাস্থের কদর ছিলো বেশি। পোশাকের চাকচিক্য দেখা হতো না। দেখা হতো পোশাকের ভেতরের দেহটা কেমন। কুস্তি কাবাডি ছিলো মানুষের প্রিয় বিনোদন।
কোন গ্রামের পালোয়ান বা কাবাডি খেলোয়াড় যদি হেরে যেতে সারা গায়ের নাক কাটা যেতো। আমাদের গাঁয়ে বারজন বিখ্যাত কাবাডি খেলোয়াড় ছিলো। তাদের পেশী বহুল দেহগুলো দেখার মতো ছিলো। তাদেরকে আমার এত ভালো লাগতো যে, আমিও স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিতে শুরু করলাম………
ওয়ারিস শাহ গেয়ে যেমন নাম হয়ে গেলো। কাবাডির কোর্টে নামার পরও বড় বড় খেলোয়াড়রা সার্টিফিকেট দিয়ে দিলো যে, চেষ্টা করলে আমিও নামাকরা খেলোয়াড় হতে পারবে। তাদের উৎসাহে আমার আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো। ছয় মাসের নিবিড় প্রশিক্ষণ আমাকে আমাদের গ্রামের মান রাখার উপযুক্ত করে তুললো।
গাঁয়ের বড় চৌধুরী আমার জন্য রোযানা এক সের দুধের ব্যবস্থা করে দিলেন। আরেক চৌধুরী খাঁটি ঘি ও মধুর দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে আমার স্বাস্থ্য এমন চমৎকার হয়ে উঠলো যে, আমার চেয়ে বয়সে বড় যুবকরাও ঈর্ষা করতো,
প্রথম দফায় তিন চার গ্রামের সঙ্গে জিতে এলাম আমরা। আমাদের জেলার এক গ্রামের কাবাডি খেলোয়াড়দের খ্যতি ছিলো দূরদূরান্ত পর্যন্ত। আমরাই ওদেরকে হারিয়ে ভালো একটা শিক্ষা দিয়ে দিলাম।
মাজারের উরসে কাবাডি খেলা হতো। পীরের মুরিদ, মুসলমান হিন্দু সবাই খেলা দেখতে আসতো। ঐ গ্রামের খেলোয়াড়রাও আসতো। শক্ত লড়াই হতো। হার জিতের মধ্যে ব্যবধান হতো উনিশ বিশ।
ওদের গ্রামেও আমরা কাবাডি খেলতে গিয়েছি। কাবাডি খেলা শেষ হওয়ার পর আমাদের বেশ ঘরোয়া আপ্যায়ন করতো তারা। আর প্রতিবারই ওয়ারিশ শাহ শোনাতে হতো আমাকে। গাওয়া শেষ করার পর ন্যরানাও মিলতো……
গায়ক ও খেলোয়াড় হিসেবে আমার তো বেশ নামডাক হয়ে গেলো। কিন্তু আমি রয়ে গেলোম নিচু জাতের সেই অচ্ছুত মানুষ। কয়েকবারই আমার কানে একথা এসেছে
জাত তো কামিন, তবে খোদা গুন দিয়েছে ছেলেটাকে।
গ্রামে আমার আলগা একটা সম্মানের স্থান হয়ে গেলো। কিন্তু উঁচু জাতের কারো সঙ্গে বসতে পারতাম না। আর বেগার খাটারও কোন শেষ ছিলো না…….
জাতপাতের এই নিচুতা আমাকে বড় কষ্ট দিতো। এক সময় আমি গ্রামের বাইরে বাইরে কাটাতে লাগলাম। বেশির ভাগ সময় পীরের আস্তানায় কাটতো। পীরও আমাকে খুব পছন্দ করতেন।
কিছু দিনের মধ্যে সেখানকার এমন কিছু লোকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়ে গেলো যারা জুয়া খেলা, চুরি করা এসব কাজকে অন্যায় মনে করতো না।
এরাও আমার মতোই কামিন জাতের লোক ছিলো। কামিন জাত হওয়ার কারণে যেন পীর এদেরকে আরো বেশি পছন্দ করতেন।
দেখতাম, মাঝে মধ্যে ওরা পীরের সঙ্গে ভেদের কথাও বলে। এদের দলে আমি ভালো করেই মিশে গেলাম। এক সময় তাদের জুয়ার আড্ডায়ও আমার স্থান হয়ে গলো…..
***
মাজারে অনেক মেয়ে ছেলেও আসতো। একদিন পীরের ডেরার দিকে যাচ্ছিলাম। পথের দুপাশের গম ক্ষেতের শীষগুলো বেশ উঁচু হয়ে উঠেছে। এখনো হলুদ বর্ণ ধারণ করেনি রং। বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে গমের শীষ……….
আমি প্রকৃতির মধ্যে ডুবে গিয়ে হাটছিলাম। আচমকা ক্ষেতের আল থেকে এক মেয়ে বেরিয়ে আসলো। যেন নীল পরী। রূপ যেন নিসর্গের সাজকেও হার মানায়। দেখেই বুঝলাম, বিত্তশালী ঘরের………
সে হেসে জিজ্ঞেস করলো, পীরজির কাছে যাচ্ছো?
আমি বললাম, হ্যাঁ……
সে বললো, একটু আস্তে হাটো। আমিও ওদিকে যাচ্ছি বলতে বলতে আমার পাশে চলে এলো।
হাটছে আর কথা বলছে এমন করে, যেন সে আমার গ্রামের মেয়ে। শিশু কাল থেকেই আমাদরে পরিচয়। আমি তার গ্রামের নাম জানতে চাইলাম। সে যে গ্রামের কথা বললো, সে গ্রামে অনেকবার কাবাডি খেলতে গিয়েছি। ওরা কখনোই জিততে পারেনি আমাদের সঙ্গে।
মেয়ের নাম তামীমা বানু, বাবার নাম শুনে তো ঘাবড়ে গেলাম। সে গ্রামের বিশিষ্ট ধনী আর চৌধুরী জাত। আমার ভয় পাওয়ার কথা ছিলো না। কারণ আমার মনে কিছুই ছিলো না। কিন্তু সে যাচ্ছিলো আমার সঙ্গে ……
কেউ দেখে ফেললে আমাকে বেইজ্জতিও করতে পারে। আর একথা তো বলবেই, আরে কামিন জাত! তোর এত বড় সাহস?
আমি একবার দ্রুত পা চালিয়ে ওকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করলাম। তামীমা খপ করে আমার হাত ধরে বললো- আমাকে রেখে পালিয়ে যেতে পারবে না।
ওর মুখে ও ঠোঁটে রাঙাবর্ণ খেলে যেতে দেখলাম। শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা না থাকলেও এবং আনাড়ি হলেও এই দূরন্ত বয়সের যে কোন ছেলেই এর অর্থ বুঝতে পারবে। আমি শিওরে উঠলাম। ওকে এড়াতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ও ছিলো শাহজাদী আর আমি গোলাম…….।
যেমন খুশি তেমন হুকুম সে আমার ওপর চালাতে পারে। উঁচু জাতওয়ালারা কোন পাপ করলে নিজেদের অধিকার আছে মনে করেই করে।
তামীমা বললো- তুমি এমন ভীত হয়ে পড়লে কেন? কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি বলব, মাজার যাচ্ছি। একে আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।