উপহার হিসেবে দুটো জিনিস নিয়ে গেলাম। চাচী অর্থাৎ চাচা মাজেদের স্ত্রীর খুব পছন্দ হলো সেগুলো। সারাদিন সেখানে রইলাম। সন্ধ্যায় ফিরে এলাম। কয়েকদিন পর আবার গেলাম। তৃতীয় সাক্ষাতে চাচা মাজেদ আমাকে ছেলের মর্যাদা দিয়ে দিলেন। তাদের কোন ছেলে মেয়ে নেই।
আমার সহকর্মীর কাছ থেকে তার সম্পর্কে যা শুনেছিলাম চাচা মাজেদ তার কিছু সত্য বলে জানালেন। আর কিছু গুজব বলে উড়িয়ে দিলেন। চতুর্থ সাক্ষাতে তিনি আমাকে তার জীবনের অতি চমকপ্রদ কাহিনী শোনালেন।
***
দক্ষিণ পাঞ্জাবের এক গ্রামে দরিদ্র এক পিতার ঘরে আমার জন্ম।–চাচা মাজেদ নিজের জীবনের গল্প শুরু করলেন।
বুঝতে শিখার পর আমার বাবাকে বিত্তশালীদের ঘরে চাকর খাটতে দেখেছি। যার বিনিময়ে আমরা দানা পানি পেতাম।
ঈদের সময় সালামী আর রঙ্গীন কাপড় পেতাম। আমার বাবার মতোই আমি সেই ছোট থেকেই উঁচু জাতের লোকদের বেগার খাটতে শুরু করি……
কিন্তু উঁচু নিচুর এই ফারাক আমি মেনে নিতে পারতাম না। শীত বা গরমে কখনো জুতা পায়ে দেয়ার ভাগ্য হয়নি। আমার বয়সের ছেলেরা কত সুন্দর সুন্দর জুতা পরতো। দশ বছর বয়স পর্যন্ত আমার একটিই কাপড় ছিলো। সেলওয়ার বা চাদর কেবল ঈদে পড়তে পারতাম……..
বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেও চৌধুরী বাড়ি থেকে ডাক আসলেই ছুটতে হতো বাবাকে। একান্তই যেতে না পারলে আমার মা যেতো। পুরষালী কাজ হলেও আমার মাকেই করতে হতো।……
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরের এই অনুভূতি দৃঢ়তর হলো যে, আমিও ওদের মতোই মানুষ যারা আমাকে ও আমার মা বাবাকে গোলাম বানিয়ে রেখেছে। কোত্থেকে এ অনুভূতি আমার ভেতর জন্ম নিলো জানি না।
পড়া লেখা জানতাম না তাই এসব কথা বই থেকে পড়ারও প্রশ্ন উঠে না। কেউ বলেওনি এসব কথা। না কখনো তারা এই ভাগ্যহত জীবনের জন্য দুঃখবোধ করেছে। তারা আমাদের এই লাঞ্চনার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের জন্য সম্মানজনক জীবনের কল্পনাও করেনি..
মনে মনে আমি যাই ভাবি না কেন তা তো প্রকাশ করার মতো সাহস ছিলো না। তবে খোদা আমাকে কণ্ঠ দিয়ে আমার জ্বালা কিছুটা হলেও ভুলে থাকার সুযোগ দিয়েছিলেন।…..
আমাদের গ্রামে এসে এক অন্ধ গায়ক ওয়ারিস শাহের সংগীত গাইতেন। তার কাছ থেকে শুনে শুনে আমি কয়েকটা কলি মুখস্থ করে নিই। ক্ষেত খামারে গিয়ে সেই কলিগুলো গুন গুন করে আওড়তাম। নিজের কণ্ঠ নিজের কাছেই বেশ লাগতো।
একদিন সেই অন্ধ গায়ককে ধরলাম, আমাকে গান শেখাতে হবে। তিনি তখন আমার গানের গলা শুনতে চাইলেন। আমি শোনাতেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি আমার গুরু হয়ে গেলেন। ওয়ারিশ শাহের অনেক গান জানি আমি। সব তার কাছ থেকেই শোনা এবং শেখা……..
গ্রামের লোকেরা আমার কাছে ওয়ারিস শাহ শুনতে চাইতো। আমার কাছে ভালো লাগতো। আমি ভেবে ছিলাম, এই কষ্টের কারণে হয়তো সবার চোখে আমি কিছুটা হলেও সম্মানের পাত্র হবো। কিন্তু এ ছিলো আমার অলীক কল্পনা। উঁচু জাতের লোকেরা আমাকে তাদের ব্যবহারে জানিয়ে দিলো যে, তোমার কণ্ঠের মূল্য থাকতে পারে, তোমার কোন মূল্য নেই আমাদের কাছে।
কখনো কোন চৌধুরীর বাড়িতে অতিথি এলে আমার ডাক পড়তো। আমাকে ফরশের ওপর বসিয়ে বলতো
আরে ছেমরা! ওয়ারিস গীত শোনা!
আমি গেয়ে শোনানোর পর হুকুম হতো- যা, যা ভাগ। আমি সেখান থেকে চলে আসতাম…..
এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেলো। কারো হুকুমে গাইতে আমার ইচ্ছে হতো, সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দিতাম।
আমার গ্রাম থেকে তিন চার মাইল দূরে এক পীরের আস্তানা ছিলো। সেখানে একটি প্রসিদ্ধ মাজারও আছে। তার মুরিদ দূরদূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিলো। শোনা যেতো, জিনদের মধ্যেও তার মুরিদ আছে। তারা সালাম করতে আসে নিয়মিত।
পীর মধ্য বয়স্ক ছিলেন। তার প্রথম স্ত্রী এক যুবক ছেলে রেখে মারা যান। তারপর পীর আরো দুই বিয়ে করেন। একজনের বয়স হবে ত্রিশ বত্রিশ। আরেকজন সদ্য যুবতী। বয়স তার ছেলের সমান…..
একদিন আমার অন্ধ গুরু আমাকে সেই পীরের কাছে নিয়ে গেলেন। পীর সাহেব নাকি ওয়ারিসশাহ ও সুরেলা কণ্ঠের পাগল। আমার বয়স তখন ষোল কি সতের। পীরের নির্দেশে আমি গেয়ে শোনালাম।…..
শেষ হতেই পীর আমার অন্ধ গুরুকে বলে উঠলেন
হাফেজ! এই ছেলে তোমার নাম ডুবাবে।
তাকে হাফেজ বলেই ডাকা হতো।
হাফেজ বললেন, ইয়া সরকার! এতো আল্লাহর দেয়া নেয়ামত। আমি তো সরকারকে খুশি করতে চেয়েছি। এজন্য আমার চেয়ে মধুর কণ্ঠস্বর আপনার দরবারে হাজির করেছি…….
***
আমার গান শুনে খুশি হয়ে পীর সাহেব তার মুরিদ বানিয়ে নিলেন আমাকে। সেদিন থেকে প্রত্যেক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তার দরবারে হাজিরা দিতাম। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সেখানে মেলা বসতো। বিভিন্ন পেশার নারী পুরুষ দলে দলে মাজারে বাতি জালাতে ও পীরকে সালাম করতে আসতো। যুবতী ও মেয়েরাও আসতো………
আজকাল তো ফিলি আর অবাস্তব গান চার দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সুরেলা কণ্ঠস্বরও কমে গেছে। আমাদের সময় লোকেরা ওয়ারিস শাহ, ইউসুফ যুলেখা ও সাইফুল মুলুকের গীত শুনতো।
গায়কদের পেছনে লম্বা লাইন দেখা যেতো। গভীর রাতে তাদের কণ্ঠ ধ্বনি যে পর্যন্ত পৌঁছতো সে পর্যন্ত মুগ্ধতার নৈঃশ্বদ নেমে আসতো। লোকেরা পছন্দ করতো সুরেলা কণ্ঠ।