আমি মহিলার চোখে চোখ রেখে মুখে মাপা হাসির রেখা ঝুলিয়ে এমন দুটি কথা বললাম, সে বুঝে গেলো আমাকে ধোকা দেয়া সহজ কাজ নয়।
ঠাকুর সম্পর্কে যা তার জানা আছে সব খুলে বলতে বললাম।
ঠাকুর হত্যার কোন করণও যদি জেনে থাকো তাও বলে দাও আমি বললাম।
আমি এত ভেতরের খবর জানি না- মহিলা বলতে লাগলো- খুন করার মতো উনার সঙ্গে কারো এত শক্ত দুশমনী ছিলো এতো আমি ধারণাও করতে
পারি না। বাগানবাড়ির ঐ ঘরগুলোর ভেতর ঠাকুর কি করতেন না করতেন তা আমার জানার কথা নয়। এটা দুর্গা জানে। যে মেয়েদের সঙ্গে উনার সম্পর্ক ছিলো তা আমি বলে দিচ্ছি।
মহিলা তিন চারটি মেয়ের নাম বললো। কিন্তু আমার সব মনোযোগ ছিল দুর্গার দিকে। মহিলাকে দুর্গার স্ত্রী ও বোন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। মহিলা জানালো, ওরা দুজন খুব চালাক মেয়ে।
এই মহিলার হাতে ঠাকুর দুর্গার বউ ও বোনোর জন্য উপহার পাঠাতেন। তারা উপহার গ্রহণ করতে ঠিক; কিন্তু ঠাকুরের হাতে ধরা দিতো না। ঠাকুর ওদের ঘরে গেলে দুজনে বেশ খাতির যত্ন করতো কিন্তু কাছে ঘেষতো না।
আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, দূর্গা জেনে ফেলেছিলো, ঠাকুর তার বউ ও বোনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চাইতেন।- আমি জিজ্ঞেস করলাম।
না- মহিলা বললো- আমি সব সময় সতর্ক ছিলাম। অবশ্য দুর্গা যদি কোন সন্দেহ করে থাকে অথবা ওর বোন বা বউ যদি দুর্গাকে বলে থাকে সেটা তো আমার জানার কথা না।
মহিলাকে নিয়ে আমি অনেক মাথা খরচ করলাম। তার কাছ থেকে এতটুকুই পেলাম যে, ঠাকুর নারী শিকারি ছিলো। আমার মতে তার হত্যার কারণও এটাই। এখন প্রশ্ন হলো, সেই মেয়েটি কে? যার কারণে ঠাকুরকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে।
মহিলাকে তখনোই ছেড়ে দিলাম না। হেড কনস্টেবল ও পাহারাদারকে বললাম, আমাকে দুর্গার বাড়িতে নিয়ে চলো। চৌকিদার আমাদের আগে আগে চললো।
এক বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমার ইংগিতে দরজায় জোরে জোরে আঘাত করলো। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো না। দ্বিতীয় বার খট খটানোর পর দরজা খুললো। আমি টর্চ জালালাম।
দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো এক মেয়ে। হয়তো দূর্গার স্ত্রী হবে।
চৌকিদার বললো- পুলিশ।
আমি মহিলাকে উঠোনে নিয়ে আসতে বললাম। মহিলা নিজেই উঠোনে চলে এলো।
দুর্গা কোথায়?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।
কাল সন্ধ্যায় বের হয়েছে। এখনো ঘরে ফিরেনি- আতংকিত গলায় বললো।
কোথায় গিয়েছিলো?
ঠাকুরের বাড়ি।
এ সময় কামরা থেকে আরেকটি মেয়ে বেরিয়ে এল।
কি হয়েছে? কে এখানে?- ঘাবড়ানো গলায় বলতে বলতে সে এলো।
আরে আলো জ্বালো, ইনি পুলিশ ইনস্পেকটর সাব- পাহারাদার বললো।
মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে আলো জ্বালালো। ওদিকে আমার কনস্টেবলরা তল্লাশি শুরু করে দিয়েছে। আমি ঘরের ভেতর চলে গেলাম। ঘরে একটি চারপায়া ছিলো।
চারপায়ার ওপর এক বুড়ি সদ্য ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে চোখ ডলছিলো। ঘরের দুদিকে দুটি কামরা ছিলো। একটার মধ্যে গেলো হেড কনস্টেবল। আরেকটার মধ্যে আমি।
চারপায়ার নিচে, জিনিসপত্রের আড়ালে আড়ালে সব খানে খুঁজলাম। সারা বাড়িতে চিরুনী তল্লাশি চালালাম। দুর্গার ছায়াও বের করতে পারলাম না।
বুড়ি দুর্গার মা। বয়স বেশি নয়। কিন্তু সেদিন খুব জ্বর ছিলো। জরের কারণে শরীর দুর্বল হলেও মুখ চলছিলো বুড়ির পুরো দমে। একথা ওকথা বলে বিরক্তি প্রকাশ করছিলো।
কেন এত রাতে হাঙ্গামা? তার ছেলে এমন কি অন্যায় করেছে? এমন নিষ্পাপ ছেলেটাকে নিয়ে এই রাত দুপুরে হুজ্জতি করা কি ভদ্রতা?
বুড়ির কোন কথার উত্তর দিলাম না আমি।
সেখানে দুর্গার বউ ও বোন দাঁড়িয়ে ছিলো। আমার সোর্স এদের রূপ সম্পর্কে যা বলেছিলো তা আসলে অনেক কম বলেছিলো। এরা এর চেয়ে অনেক বেশি রূপসী।
ওদেরকে বাইরের কামরায় নিয়ে এলাম। আমি চারপায়ার ওপর পা তুলে বসলাম আগে। তারপর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলাম। প্রথমে দুর্গার স্ত্রীকে তারপর তার বোনকে জিজ্ঞেস করলাম।
দুজনেই জানালো, ওরা ঠাকুরের বদ নিয়ত বুঝতে পারতো, কিন্তু ঠাকুরের দেয়া জিনিসও ফিরিয়ে দিতো না।
দুর্গা কি এসবে সন্দেহ করতো না?
সন্দেহ কেন করবে?- দুর্গার স্ত্রী জবাব দিলো- বদ নিয়ত ছিলো ঠাকুরের। আমাদের নিয়তে কোন দোষ ছিলো না। আমাদের দুজনের কেউ কখনো উনার সঙ্গে একা কথা বলতাম না।
দুজনেই খুব চালাক। দুর্গাকে যে ঠাকুর হত্যার তদন্তে আমি খুঁজছি এটা ওরা বুঝে গেলো।
দুর্গার বউ বললো, দুর্গা গ্রামের বাইরে কখনো গেলে ওদেরকে জানিয়ে যেতো। এবার তো সে কিছুই বলে যায়নি।
এর অর্থ হলো, দুর্গা কোথাও আত্মগোপন করেছে। কিন্তু আমি দুর্গার বউ ও বোনের সামনে এমন ভাব করলাম যে, দুর্গার ওপর যে সন্দেহ ছিলো তা দুর হয়ে গেছে, দর্গাকে এখন আর আমার দরকার নেই।
তবে সেখান থেকে বের হয়ে এসে আমার দুই সোর্সকে বলে দিলাম, দূর থেকে যেন দুর্গার বাড়ির ওপর নজর রাখে।
***
বলা যায় এক প্রকার শূণ্য হাতেই থানায় ফিরে এলাম। থানায় এসে দেখলাম আমার জন্য সাতজন লোক হাজির করা হয়েছে। ঠাকুরের বাগান বাড়িতে এরা জুয়া খেলতে আসতো। এর মধ্যে তিন চারজন উঁচু ঘরনার লোক। অন্যরা পেশাদার জুয়াড়ি। এর মধ্যে তো একজন দু বছর জেল খেটে যাওয়া দাগী আসামী।
পেশাদার অপরাধী ও জুয়াড়িদের জিজ্ঞাসাবদ একটু অন্য ধরনের হয়। কারণ এদের কাছ থেকে কথা আদায় করা বেশ মুশকিল হয়ে পড়ে। এই মামলায়ও এরা আমাকে মুশকিলে ফেলে দেয়। তবে পরে আমি সব ঠিক করে নিই। ভেতরের কথা বের করতে বাধ্য করে তুলি।