তারপর দুপুরের আগে রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে তাদের বিয়ের রেজিষ্ট্রিও সেরে ফেললো।
রাতের বেলা সারমুদের বন্ধুরা মিলে বড়সড় এক পার্টির আয়োজন করলো। বন্ধুরাই সারমুদের ঘরে বাসর সাজালো। এবং দুজনকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে সবাই বিদায় নিলো।
যা হোক, সারমুদ ভয়ে ভয়ে ছিলো। তাজ এর পরিবারের কেউ প্রতিশোধমূলক কোন ক্ষতি বা তার ওপর হামলা করতে পারে। হামলা ঠিকই করলো, তবে তাজ এর পরিবারের কেউ না। বরং তাজ এর পূর্ব স্বামী আদালত। তবে সারমুদ বেঁচে গেলো।
আমি তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিলাম। রাতের মধ্যেই আদলত ও তার আত্মীয়ের জামিন হওয়ার জন্য লোকজন চলে এলো। তাদের গ্রামের চৌকিদার ও মেম্বরও আসলো।
আমি আদালত ও তার লোকদের কাছ থেকে লিখিত জামানত নিলাম, এখন থেকে তারা সারমুদ ও তার স্ত্রীকে কোন ধরনের বিরক্ত করবে না। কেউ যদি সারমুদের ওপর হামলা করে আর হামলাকারীকে ধরা না যায় তখন আদালত ও তার সঙ্গীরাই গ্রেপ্তার হবে। তাদের জামিনদাররাও সন্দেহ ভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার হবে।
সারমুদকেও সতর্ক করে দিলাম, সে যেন এখন থেকে কোন অপরাধের সঙ্গে জড়িত না হয়। তাহলে তার কপালেও খারাবি আছে।
আমার ভেতরের সেই অপ্রাপ্তি আর শূণ্যতার আগুন নিভে গেছে। সেই আগুনই আমাকে অন্ধকার জগতে নিয়ে গিয়েছিলো
সারমুদ সতেজ গলায় বললো
আমার জীবন থেকে যা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিলো সেই মহান সত্তা তাজ ও তার সন্তানের রূপে আমাকে আবার ফিরিয়ে দিয়েছেন। খোদার দরবারে আমি এখন সত্যিকারের তওবা নিয়ে হাজির হবো। তবে এর জন্য এখন প্রকৃত আল্লাহ ওয়ালা এক পীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করবো। শুনেছি তিনি থাকেন ইউপির সাহারানপুরের দেওবন্দে।
হৃদয়ের কাঁটা
সবাই তাকে চাচা মাজেদ বলে। না, পাড়ার বুলি হিসেবে মাজেদ সাহেবকে চাচা মাজেদ ডাকা হতো না। এই ডাকার মধ্যে শ্রদ্ধা আর সমীহের সরল অভিব্যক্তি ছিলো। কারণ, বিধাতা তাকে এমন সুর মাধুরী দান করে ছিলেন যার সুর তরঙ্গ পথিকের পথ রোধ করে দিতো। তবে তিনি হিরু ওয়ারিস শাহ গীতি ছাড়া আর কিছুই গাইতেন না।
তার গাওয়ারও কোন সময় ছিলো না। কখনো অর্ধ রাতের পর তার সুর লহরী চাঁদ তারাকেও আচ্ছন্ন করে ফেলতো। কখনো মধ্য দুপুরের উধাস হাওয়ায় হঠাৎ তার সুর বেজে উঠতো। সারা গ্রাম নিথর স্তব্ধ হয়ে যেত।
কিন্তু কেউ হাজার অনুরোধ করলেও তার গলায় সুর উঠতো না। দু টুকরো বিন্ন হাসি উপহার দেয়া ছাড়া আর কিছু দিতেন না তখন। তবে অতিথি এলে তাকে নিরাশ করতেন না। একটু বললেই হতো। চাচা মাজেদ বলতেন, আমার এই মেহমান হিরু ওয়ারিশ শাহ শুনতে এসেছে। মেহমানকে তিনি খুশি করে দিতেন।
একবার সে গ্রামে আমাকে আতিথেয়তা গ্রহণ করতে হলো। তখনই আমি তার সুরের ভক্ত হয়ে যাই। মনে করেছিলাম তার সুরে কেবল সাধারণ আকর্ষণই আছে; কিন্তু তার কাছে যাওয়ার পর অনুভব করলাম, এর মধ্যে গভীর দাগের কোন কাহিনী আছে।
সে গ্রামে যাওয়ার পট ভূমিটা ছিলো এরকম
অন্য এলাকার এক পীরের মুরিদ ছিলাম আমি। এর অর্থ এই নয় যে, আমি অশিক্ষিত, গোঁয়ার। পরীক্ষা না দিলেও বি.এ. পর্যন্ত পড়া আছে আমার। তবে আমার বাবার মুখে শৈশব থেকেই সেই পীরের কারামত শুনে এসেছি।
আমাদের বংশের সবাই ঐ পীরের মুরিদ। পীরের গদি আমাদের এলাকা থেকে একটু দূরে। বছরে দুবার পীরের আস্তানায় যেতাম। একবার শুধু সালাম করতে। আরেকবার বাৎসরিক উরসে।
অন্যদের মতো আমিও বিশ্বাস করতাম, পীরের কজায় জ্বিন আছে। কাউকে যদি জিন উত্যক্ত করতে পীর সেই জিনকে হাজির করে শাস্তি দিতেন। এ ধরনের অনেক কাহিনী আমি সত্য বলে বিশ্বাস করতাম।
সে বছর উরসে গিয়ে আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। উরসে কাওয়ালির তিনটি দল এসেছিলো। কাওয়ালি আমার খুব প্রিয়। কাওয়ালির এক গায়কের সুর আমার কাছে খুব ভালো লাগলো। আমার সহকর্মীকে তার কথা বলছিলাম।
তুমি হৃদয়কাড়া সুর যদি শুনতে চাও আমাদের গ্রামে চলো- সহকর্মী বললো।
সে চাচা মাজেদের কথা বললো। বিভিন্ন কাওয়ালি ও গানের দল তাকে তাদের দলে ভেড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু তিনি এসবে পাত্তা দেন না। পীরেরাও তাকে উরসের সময় দাওয়াত করেন। তিনি সাড়া দেন না। আমার সহকর্মীর কথা শুনে মনে হলো, চাচা মাজেদ অন্যদের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম এবং পোড় খাওয়া মানুষ।
***
রাতে চাচা মাজেদের বাড়িতে আমার মেজবান সহকর্মীর সঙ্গে বসেছিলাম। চাচার বয়স পৌঢ়ত্বে ছাড়িয়ে গেছে। তার ও এক স্ত্রীর সংসার এটা। একেবারে আটপৌঢ়ে। দরিদ্রই বলা যায়। তবে বেশ হাসিখুশি। অভাবের জন্য তাদের মধ্যে কোন হাপিত্যেশ নেই।
চাচা মাজেদ অতিথির অনুরোধ পেয়ে আমাকে ওয়ারিশ শাহ শোনাতে বসলেন। গাওয়া শুরু করলেন। ঢোক, তবলা, হারমেনিয়াম ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র নেই। তাতে কি? চাচার কণ্ঠে সবকিছুই যেন ঝংকৃত হচ্ছে। কেমন গম্ভীর জ্বালা ধরা সুরে গেয়ে চলেছেন।
এক কলি শেষ হওয়ার আগেই দুচারজন করে শ্রোতার দল আসতে লাগলো। সবার স্থান মাটিতে। মাটিতে একটা শতরঞ্চি পাতা আছে। আশ্চর্য সেখানে কেউ বসছে না। যেন সেখানে বসলে চাচা মাজেদের সঙ্গে বেয়াদবি হবে।
সেখান থেকে আমি যে সুধা নিয়ে ফিরলাম তা আমার শুকনো জীবনকে করে তুললো রসাবৃত। আমার সহকর্মী তার সম্পর্কে পরে এমন দুএকটা কথা বলেছিলো, যার টানে পনের ষোল দিন পর আমি আবার সে গ্রামে গিয়ে উঠলাম।