সেখান থেকে পলানোর অপরাধে আমাকে যদি ফাঁসিও দেয়া হয় তবুও তাজের নাম আমি নেবো না। আপনি দয়া করুন- সে বললো।
তাজের সব কথা শুনে আমিও তাজের সঙ্গে ওয়াদা করেছি, তার কথা কাউকে বলবো না।
সে কি বলেছিলো, আমার ভালোবাসার বিনিময়ে আমাকে ওখান থেকে বের করেছে?- সারমুদ জিজ্ঞেস করলো।
তার ইযযত রক্ষার্থে- আমি বললাম।
যাহোক সারমুদ নিজেকে অপরাধী সাব্যস্ত করার ব্যপারে আমাকে বেশ সাহায্য করলো। ও দিকে মারদানশাহ ও তার দুই চ্যলাও নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নেয়। তবে কোর্টের মাধ্যমে শাস্তি দেয়ার জন্য সাক্ষীর প্রয়োজন ছিলো।
তাছাড়া আমার রিপোর্ট সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিলো, সারমুদকে ছদ্মবেশ ধারণ অবস্থায় ধরা যায়নি। তার প্রকৃত চেহারায় কেউ তাকে চিনতো না। তবুও নিজের বানানো কয়েকজন সাক্ষী দ্বারা এই অভাবটা দূর করে নিলাম।
মজার ব্যাপার হলো, আদালতে সারমুদ তার থানার জবানবন্দি থেকে মোটেও সরে যায়নি। সব স্বীকার করে সে। একটু অস্বীকার করলেই জেল থেকে রেহাই পেতো।
তবে মারদানশাহ ও তার এক চ্যলা থানার জবানবন্দি অস্বীকার করে বসে। তাদেরকে জব্দ করার জন্য তখন কোন সাক্ষী পাওয়া গেলো না, যে এসে বলবে, এই লোক অমুক নারীর ইযযত লুটেছে।
তারপরও প্রত্যেকের দু বছর করে জেল হলো। রায় শেষে তাদেরকে যখন কোর্টের বাইরে আনা হলো, সারমুদের হাতে তখন হাত কড়া। কিন্তু তার ঠোঁটে বেপরোয়া হাসি। সে আমাকে কাছে ডেকে নিজের হাত বাড়িয়ে আমার এক হাত টেনে নিয়ে বললো,
আমি সহজেই মুক্ত হতে পারতাম। উকিল আমাকে বারবার বলেছে, তুমি মাত্র একবার অস্বীকার করো। বলল, আমাকে মেরে মেরে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। আমি শুধু দেখছিলাম, আপনি আপনার ওয়াদা পূরণ করেন কিনা। আপনি সাক্ষীতে যেই তাজের নাম উচ্চারণ করতেন আমি আমার জবানবন্দি অস্বীকার করে বসতাম। আপনি তাজের সম্মান রেখেছেন আমিও আপনার সম্মান রেখেছি।
যে রাতে সারমুদ থানায় আমার কাছে জবানবন্দি দেয়, সে রাতে সে এক পর্যায়ে বড় হতাশ ও বেদনাহত কণ্ঠে বলে ছিলো
হায় তাজকে আমি সারা জীবন পাবো না। আর সারা জীবনই মানুষকে ধোকা দিয়ে যাবো।
তখন থেকেই আমার মনে এক গোপন প্রার্থনা ছিলো, কোনভাবে যদি সারমুদের স্বপ্ন পূরণ হতো!
***
এজন্যই বোধ হয়, এই মামলা তো শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু কাহিনী আরো নাটকীয়তার দিকে এগিয়ে গেলো। এই মামলার বেশ অনেক দিন পর বিশেষ প্রয়োজনে আমাকে অন্য এক থানায় ইনচার্জ দেয়া হলো। সেখানে দু বছর কাটানোর পর জরুরী ভিত্তিতে আবার সারমুদ যে শহরে থাকতো সে শহরের থানায় পোস্টিং দেয়া হলো।
আগের থানায় থাকতেই আমি ততদিনে সারমুদের স্মৃতি প্রায় ভুলে গেছি। পৌনে তিন বছল অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিলো। এর মধ্যে হাজারো মামলা আমার হাত দিয়ে বেরিয়েছে। কতজনের কথা মনে রাখা যায়।
এই থানায় আসার পনের ষোল দিন পরের ঘটনা। থানার এক হেড কনস্টেবল ও আরেক কনেস্টবল মারামারির অভিযোগ তিনজনকে থানায় নিয়ে এলো। তাদেরকে বাইরে বসিয়ে হেড কনষ্টেবল এসে আমাকে জানালো, এদের একজন এই শহরেরই। দু জন্য দেহাতী অর্থাৎ গ্রামের দেহাতীরা শহরির ওপর প্রকাশ্যে বাজারে ছুড়ি দিয়ে হামলা করে।
শহরি এতে মোটামুটি যখমী হয়। শহরির হাতে সাইকেলের একটা হেন্ডেল ছিলো। আত্ম রক্ষার্থে শহরিও সে হেন্ডেল দিয়ে পাল্টা আঘাত করে। বাজারের লোকেরা তাদেরকে তাড়িয়ে দিলো। কিন্তু দেহাতীরা নিয়ন্ত্রণে আসেছিলো না। দুই পুলিশ সেখান দিয়ে যাচ্ছিলো। হাঙ্গামা দেখে সেই তিনজনকে পুলিশ থানায় নিয়ে আসে।
তিনজনকে ভেতরে আনা হলে আমি শুধু চমকেই উঠলাম না। প্রচন্ড এক ধাক্কা খেলাম ভেতর ভেতর। এক লহমায় চিনে ফেললাম।
তিনজনের একজন সারমুদ, আরেকজন আদালত, অন্যজন আদালতের এক আত্মীয়। আমি বুঝে ফেললাম, মারপিটের কারণ কি? কিন্তু তাদের কথা শোনার পর দেখা গেলো ব্যপার আরো অনেক সঙ্গিন।
আগে যখমগুলো দেখলাম। সারমুদের মাথার একটা জায়গায় চার পাঁচ ইঞ্চি হিড়ে গেছে। আর সারমুদের আঘাতে তারা শুধু ব্যথা পেয়েছে, যখমী হয়নি।
থানায় ফাষ্ট এইড-এর ব্যবস্থা ছিলো। সারমুদের মাথায় ব্যান্ডেজের কথা বলে ওদের চোটে ঔষধ লাগিয়ে দিতে বললাম।
প্রথমে আদালতকে জিজ্ঞেস করলাম, সারমুদকে সে কেন হত্যামূলক আক্রমণ করলো।
ওর কাণ্ড কারখানার কথা কি আপনার মনে নেই? আদালত আমাকে জিজ্ঞেস করলো।
আমাকে প্রশ্ন করবে না। আমি রাগত কণ্ঠে বললাম- সব মনে আছে আমার। সে তোমাকে গুপ্তধন ও তোমার স্ত্রীকে সন্তান দেয়ার ধোকা দিয়েছিলো। আর তুমি ছয় সাত রাতের জন্য তোমার স্ত্রীকে তার কাছে হাওলা করে দিয়েছিলে। আইন তাকে তার প্রাপ্য শাস্তি দিয়ে দিয়েছে। তুমি এখ কি চাও? তুমি ওকে হত্যার জন্য যে হামলা করেছে এর শাস্তি সাত বছরের জেল। দশ বছরও হতে পারে।
জনাব!–আওয়াজ তার মৃত প্রায়- আসল কথা হলো, আমার স্ত্রীকে সে বিয়ে করে ফেলেছে।
আমি অত্যন্ত হয়রান হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
সে কি তোমার স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে এসেছে? যদি অপহরণ করে থাকে তুমি থানায় রিপোর্ট করলে না কেন?
আমি রিপোর্ট করবো কিভাবে জনাব?- আদালত বলে গেলো। আমি তো আমার স্ত্রীকে আগেই তালাক দিয়ে দিয়েছি।