পাক্কা বদমায়েশ আদমী হুজুর!- বুড়ো নওকর এ কথা বলেই হাত জোড় করে ভীত গলায় বললো- হুজুর! একথা আমার মুখ থেকে বের হয়ে গেছে। দুর্গা পর্যন্ত যদি আমার এ কথা পৌঁছে তাহলে সে আমার ঝুপড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে।
অন্যদের মতো বুড়োও জানতো না, রাতে ঠাকুর কোথায় ছিলো। আমি এক কনস্টেবলকে ডেকে বললাম, ঠাকুরের বাড়িতে গিয়ে তার ছেলেকে বলো দুর্গাকে যেন এখানে পাঠিয়ে দেয়।
কনস্টেবল যখন ফিরে এলো তার সঙ্গে তখন দুর্গা ছিলো না, ছিলো ঠাকুরের ছেলে।
দুর্গা কোথায়?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।
আমি তো এ জন্যই এসেছি- ঠাকুরের ছেলে বললো- বাবার এই আকস্মিক মৃত্যুতে আমি এমন দিশেহারা ছিলাম যে, কোথায় কি ঘটেছে সে খবরও ছিলো না আমার। দুর্গাকে তো সকাল বেলাই দেখা যায়নি। এখন পর্যন্ত তার কোন হদিস নেই।
সে তো সকাল সকাল আমাদের বাড়িতে চলে আসতো। আপনার কনস্টেবলের সঙ্গে দুর্গার বাড়িতে গিয়ে ওর মাকে জিজ্ঞেস করে ছিলাম। ওর মা ও বউ বললো, কাল সন্ধ্যায় যে দুর্গা বের হয়েছে আজ সারা দিনেও ফিরেনি দুর্গা। যাওয়ার সময় বলেছিলো, ঠাকুরের কাছে যাচ্ছে।
দুর্গার গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা আমার তদন্তের জন্য একটা সূত্র হতে পারে ভেবে আমি কিছুটা নির্ভার বোধ করলাম। অবশ্য দুর্গাকে ঠাকুর সাহেব কোন কাজে অন্য কোথাও পাঠিয়ে থাকতে পারেন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আজকের রাতটা দুর্গার অপেক্ষায় কাটাবো।
ঠাকুরের ছেলে জানালো, দুর্গা খুন জখম করার মতো লোক নয়। তবে মন্দ লোক যে, এতে কোন সন্দেহ নেই। গ্রামের লোকেরা তাকে খুব ভয় পায়। সে ছিলো ঠাকুরের বডিগার্ড।
উল্লেখযোগ্য কোনই সূত্রই আমি পেলাম না। তাই রাতটা বাগান বাড়িতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। চৌকিদার ও পাহারাদাররা বাইরে যার যার ডিউটিতে ছিলো। থানার সোের্সরাও তৎপর ছিলো বেশ। সোর্সদের মধ্যে দুজন তো বেশ অভিজাত ঘরের লোক। কিন্তু থানা পুলিশ ও তদন্ত কাজে গুপ্তচরবৃত্তি করার কাজ করতো তারা খুব আন্তরিকতা নিয়ে। এটা ছিলো তাদের শখের পেশা।
আজকাল এ ধরনের লোক কমই পাওয়া যায়। যারা অপরাধের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে এভাবে উজাড় করে দিতে পারে।
রাতে আমি একবার থানা সোর্সদের কাছ থেকে রিপোর্ট নিলাম। তবে আলাদা আলাদাভাবে। দুর্গার ব্যপারে সবাইকেই বিশেষভাবে জিজ্ঞেস করলাম। এটা তো সব পুলিশ অফিসারই জানেন যে, ঠাকুর, শেঠ ও জায়গীরদারদের খাস নওকর ও বডিগার্ড থাকে। মুনিবের হুকুমে তারা নারী অপহরণ ও হত্যার ঘটনা ঘটায়। মুনিবদের ফুর্তি করার উপকরণও এরাই জোগাড় করে দেয়। অনেক গোপন ব্যাপারও এরা জেনে থাকে।
সোর্সদের কাছ থেকেও জানা গলো, ঠাকুর ফুর্তিবাজ লোক ছিলো।
বাগানে জুয়া খেলা হতো, নাচ গান হতো। কারা জুয়া খেলতে আসতো, নাচগান করতে আসতো, তাদের নামের ফিরিস্তি আমার সামনে পেশ করা হলো। তবে ঠাকুর মারা যাওয়ার রাতে নাচগান করতে কেউ আসেনি।
বাগানের তিন নওকরও জানালো, নাচগান হলে তারা নিশ্চয় টের পেতো। কারণ, যখন গানবাজনা হয় তখন ঢোল তবলার আওয়াজ তাদের ঝুপড়ি থেকেও শোনা যায়।
জনাব! সবচেয়ে দৃষ্কৃতিকারী ছিলো ঠাকুর- এক অভিজ্ঞ সোর্স জানালো দুর্গার প্রতি ঠাকুর দুর্বল ছিলো এজন্য যে, দুর্গার বউটি খুব সুন্দরী। আর তার সুন্দরী একটি বোনও আছে। বয়স একুশ বাইশ হবে। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হয়নি বলে দেড় বছর ধরে বাপের বাড়ি পড়ে আছে। ঠাকুর দুর্গাদের বাড়িতে প্রায়ই যেতেন।
দুর্গা কি তা জানতো?
কি জানি! দুর্গা হয়তো ঠাকুরের আসল নিয়তের কথা জানতো না।
….দুর্গার একটা জিনিস সবাই খুব পছন্দ করে, গ্রামের যেকোন মেয়ে হোক, নষ্টা মেয়ে হলেও দুর্গা সে মেয়েকে ইজ্জত করে। মন্দ দৃষ্টিতে কোন মেয়ের দিকে সে তাকায় না। এ থেকেই বুঝা যায়, দুর্গা ঠাকুরের তার বাড়িতে আসা যাওয়ার ব্যপারটা পুরোপুরি জানতো না।
হতে পারে, ঠাকুরের নিয়ত খারাপ ছিলো না।
ঠাকুরের নিয়ত ভালো হতেই পারে না। ইনস্পেকটর সাহেব! আমার তো মনে হয়, দুর্গা ঠাকুরের কাজে অন্য কোথাও যায়নি। সে আত্মগোপন করেছে। সে তার বউ বা বোনের সঙ্গে হয়তো ঠাকুরকে দেখে ফেলেছিলো। তারপর….
কোথায় যেতে পারে সে?
ওর তো অনেক ঠিকানা আছে। ডাকু ও ছিনতাইকারীদের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ছিলো।
***
আমি রাতের মধ্যেই চৌকিদার, পাহারাদার ও পুলিশ কনস্টেবলকে পাঠিয়ে দিলাম যে, বাগান বাড়িতে যারা জুয়া খেলতে ও নাচ গান করতে আসতো সকালে ওদেরকে থানায় হাজির করতে হবে।
আমাকে এক মহিলার কথা বলা হলো, যে ঠাকুরের বাগান বাড়িতে কাজ কর আসতো। মহিলা এমনিতে খুব সাধারণ। চার পাঁচ বছর হলো বিধবা হয়েছে।
অর্ধেক রাত পার হয়ে গেছে। রাতের বিশ্রাম বাদ দিয়ে দিলাম। চৌকিদারকে ডেকে বললাম, ঐ বিধবা মহিলাকে নিয়ে এসো।
মহিলা ভীত কম্পিত হয়ে আমার কাছে এলো। একে দেখেই মনে মনে বললাম, এই মহিলা আমার কাজে আসবে। বয়স তার ছত্রিশ সাতত্রিশ হবে। এ ধরনের মহিলা গ্রামের মতো শহরেও আছে। পুলিশ এদেরকে ভালো করেই চিনে।
এদের নামধাম, আকার আকৃতি ভিন্ন হলেও এদের কাজ হয় অভিন্ন। মহিলাকে আমি বসিয়ে বললাম, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যা জিজ্ঞেস করবো ঠিকঠাক জবাব দিলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে।