মালি তিনজনকে ডেকে আনলাম। ঠাকুর মারা গেছে এ সংবাদ এরা না জানলেও এতটুকু জানে যে, ঠাকুরকে নিয়ে কোন ঝামেলা হয়েছে।
আমি তাদেরকে এক জায়গায় বসিয়ে বাড়িটি দেখার জন্য ভেতরে চলে গেলাম। এখানে এসেছিলাম আমি একাই। ঠাকুর বাড়ির কাউকে আনিনি।
দেখলাম, এক ঘরের দরজার ভেতর দিকের চাবিসহ তালা ঝুলানো। মালি তিনজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,
ঠাকুর এখানে না থাকলে কি দরজা তালা লাগানো থাকে?
জি হুজুর!- এক মালি জবাব দিলো- তালা তখনই খোলা হয় যখন ঠাকুরজি আসেন এখানে। সকালে দরজায় তালা না দেখে ভেবেছিলাম, ঠাকুর সাব ভেতরে শুয়ে আছেন।
এদেরকে আরো কিছু জিজ্ঞেস করার আগে ভেতরটা আরো ভালো করে দেখে নেয়া জরুরী। উঠোনটা ঘুরে ফিরে কামরার ভেতরে গেলাম। প্রথমেই নজরে পড়লো একটা বোতলের দিকে। দেশী মদের বোতল। পাশে দুটি গ্লাস রাখা। আমার পেছন পেছন হেড কনস্টেবলও চলে এসেছিলো।
তাকে বললাম, সাবধানে এগুলো উঠিয়ে নাও। কারণ, এতে আঙ্গুলের ছাপ অবশ্যই আছে। আর এই বোতলের মধ্যে যে বিশ মেশানো মদ ছিলো এতে কোন সন্দেহ নেই। গ্লাস দুটোতে তখনও কয়েক ফোঁটা মদ লেগে ছিলো।
কামরায় একটি খাট বিছানো। সুক্ষ্ম চোখে দেখলাম, খাটের চাদর এলোমেলো হয়ে আছে। নিশ্চই এখানে কোন মহিলা বা মেয়েকে নিয়ে ধস্তাধস্তি হয়েছে। দ্বিতীয় কামরায় গিয়েও তল্লাশি চালালাম। কিন্তু এখানে এমন কিছু পেলাম না যা আমাকে তদন্ত কাজে সাহায্য করবে।
ঘরের আরেক দিকের দরজা দিয়ে বাইরে তাকালাম। সেখানে ছোট একটি উঠানের মতো খালি জায়গা আছে। এরপর ছোট একটি খাল। তারপরই ফসলি ক্ষেতের দিগন্ত বিস্তৃত সারি।
সেখানে আমার তদন্তের সাহায্যের জন্য কিছু ছিলো না। আমি প্রথম কামরায় এসে খাটে উঠে বসলাম। মালিদের একজনকে রেখে অন্য দুজনকে কামরা থেকে বের করে দিলাম। এই মালিটি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলো। সহজ সুরে ওর সঙ্গে কথা বলে ভয় দূর করে দিলাম।
রাতে ঠাকুরের সঙ্গে এখানে কে এসেছিলো?- মালিকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
হুজুর! আমি ভালো করে দেখেছি, ঠাকুর সাব একলা এসেছিলো- মালি বললো।
তুমি তখন কোথায় ছিলে! বাড়ির ভেতরে ছিলে না বাইর?
বাগানে যারা কাজ করে পুরুষ হোক মেয়ে হোক কিংবা বাচ্চাই হোক ঐ বাড়ির কাছে ঘেষারও অনুমতি নেই। ঠাকুরজী ভেতরে থাকলে তো আমরা এদিকে আসার সাহসও করতে পারি না….
কাল যখন ঠাকুরজি আসেন আমি তখন দেয়ালের কাছে ছিলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন, নিজের ঘরে চলে যাও। আমি চলে এলাম।
এটা কখন?
সূর্য ডুবে অন্ধকার নেমে এসেছিলো তখন।
তুমি ঠাকুরের পর আর কাউকে বাগানে আসতে দেখেছিলে?
না, হুজুর! আমি সেখান থেকে চলে এসেছিলাম।
তুমি তো এটা জানো যে, এখানে কি হয় না হয়? ঠাকুর কি এখানে মেয়ে মানুষ আনতো না? দোস্ত ইয়ারদের নিয়ে আনন্দ করতো না?
আমি আপনাকে শুধু বলছি হুজুর! ঘরের ভেতর যা হতো তা শুধু একজন লোকই জানে…. তার নাম দুর্গা। ঠাকুরজির খাস নওকর। সে সব সময় ঠাকুরজির সঙ্গে থাকতো। নওকরদের মধ্যে দুর্গাই কেবল ঐ বাড়িতে যেতে পারতো।
সে কি রাতেও এখানে ছিলো?
ও তো সূর্যাস্তের আগেই চলে এসেছিলো। আমি ভালো করে দেখেছি যে, বাইরের দরজায় যে তালা লাগানো ছিলো সেটা দুর্গা খুলেছে।
রাতে ঠাকুর যখন এখান থেকে বের হয় তুমি তখন কোথায় ছিলে?
আমি কিছুই জানি না হুজুর! আমি আমার ঘরে চলে গিয়েছিলাম। সকালে যখন বাগানে আসি তখনো আমার ধারণা ছিলো ঠাকুর সাব বাড়ির ভেতরইে আছেন।
***
এই নওকরকে আমি অন্য কামরায় পাঠিয়ে দিলাম। যাতে সে অন্য নওকরদের সঙ্গে এখনই কিছু বলতে না পারে। তারপর দ্বিতীয় আরেক নওকরকে ডেকে আনলাম। তার জবানবন্দিও প্রথম নওকরের মতোই হলো। আমার জন্য বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া গেলো না। তাকে বলালম উঠানে গিয়ে বসে থাকো।
তৃতীয় নওকারকে এরপর ভেতরে ডেকে আনলাম। পুরনো লোক সে।
ঠাকুর সাহেবের নওকরি কত বছর ধরে করছো? আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম।
সঠিক জানা নেই হুজুর! বৃদ্ধ নওকর বললো, মোটা মোটা হিসেবে চল্লিশ বছর তো হবেই। ঠাকুরজির বিয়ে আমার সামনেই হয়েছে।
তুমি কি জানো তোমাদের ঠাকুর এখন কোথায়?
আমরা তো বলছিলাম তিনি এখানেই শুয়ে আছেন। কিন্তু পরে জানলাম, অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এখন হাসপাতালে আছেন।
আমি যদি বলি, ঠাকুর মরে গেছে, তুমি কি করবে তখন?
আমি কি করতে পারবো হুজুর! গায়ের সব ঠাকুর মরে গেলেও তো আমি ঠাকুর হতে পারবো না। আমরা তো ঠাকুরদের নওকরি করার জন্য জন্মেছি।
সে হালকা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো- তিনি কি সত্যিই হাসপাতালে না আপনি যা বলেছেন তাই ঠিক!
আমি যা বলেছি তাই ঠিক, তোমার ঠাকুর মারা গেছে। তার লাশ এখন তার বাড়িতে।
অবিশ্বাসী চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
আচ্ছা ঠাকুর নাকি মেয়েদের ব্যাপারে সুবিধার লোক ছিলো না? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
আপনি ঠিকই শুনেছেন হুজুর! পয়সা থাকলে কার চরিত্র আবার সাধু থাকে?- বুড়ো বললো।
প্রশ্নোত্তরে এই বুড়োও দুর্গার কথা বললো।
আমি বুঝতে পালাম, দুর্গাকে আমার খোঁজে বের করা জরুরী। বুড়োকে জিজ্ঞেস করলাম, দুর্গা এখন কোথায় থাকতে পারে? বুড়া জানালো, ঠাকুরের হাবেলিতে, না হয় ওর নিজের বাড়িতে।
দুর্গা লোক কেমন?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।