যা হোক, ঠাকুরের ছেলে আমাকে মূল্যবান কোন তথ্য দিলো না। হয়তো মিথ্যাই বলেছে আমার সঙ্গে। যাক, এতে আমার কিছু যায় আসে না। শক্ত হলেও আসল কথা নেয়ার মতো লোক আমি ঠিকই বের করে আনবো।
ঠাকুরকে যারা হাসপাতাল এনেছে, তাদের মধ্যে থেকে দুজনকে আমি হাসপাতাল থেকে থানায় নিয়ে এলাম। এরা ঠাকুরের আত্মীয় নয়; প্রতিবেশি। তবে একজন ঠাকুরের মতোই প্রভাবশালী স্তরের লোক।
ঠাকুরের ছেলেকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ঠাকুর কেমন লোক ছিলো, আর কি কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে?
ঠাকুরের কোন জানী দুশমনের ব্যপারে আমার জানা নেই যে, তাকে হত্যা পর্যন্ত করবে- প্রভাবশালী লোকটি বললো- তবে এতটুকু বলতে পারি, ঠাকুর খুব ভালো লোক ছিলো না। নারী ঘটিত ব্যাপারে তো সে মোটেও সুবিধার ছিলো না।
মেয়েদের মধ্যে কাদের কাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো এটা বলতে পারেন?
সে চার পাঁচজন মেয়ের কথা বললো। কিন্তু এরা সবাই গরিব ঘরের মেয়ে। ঠাকুরকে বিষ খাওয়ানোর মতো দুঃসাহস এদের কারোই হওয়ার কথা না। সে লোক আরো জানালো, ঠাকুর তার বাগান বাড়িতে প্রায়ই মদ গান ও জুয়ার মাহফিল জমাতো। নর্তকী এনে নাচাতো। গায়িকা নর্তকীদের আনতো শহর থেকে।
অনেক সময় কেটে গেলো। ইতিমধ্যে ডাক্তার তার পোষ্টমর্টেমের রিপোর্ট থানায় পাঠিয়ে দিলো যে, ঠাকুরকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে।
থানার কাজ এটা দেখা যে, ঠাকুর কি আত্মহত্যা করেছে, না তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ কারণে আমার জন্য জরুরী হলো, তার ঘর বাড়ি। ও ফ্যমিলি হিস্টোরী জানা। তার বন্ধু ও শত্রুদের মধ্যে এবং গ্রাম্য রাজনীতিতে তার কি ভূমিকা ছিলো এটাও বের করতে হবে।
কারণ, হত্যার মামলা বা তদন্তে সর্ব প্রথম দেখা হয় হত্যার আসল উৎসটি কোথায়। এটা জানা খুবই কঠিন কাজ। অনেক গভীরে ডুব দিয়ে শরীরে কাদামাটি লাগাতে হয়।
আমি ঠাকুরের গ্রামে রওয়ানা হতে যাবো এ সময় আমার জুনিয়র সাব ইনস্পেক্টর আমাকে পৃথকভাবে ডেকে নিয়ে সে গ্রামেরই একটা মামলার কথা স্মরণ করিয়ে দিলো।
চার পাঁচ দিন আগে এই ঠাকুরই তার গ্রামের এক বৃদ্ধকে নিয়ে থানায় এসেছিলো। বৃদ্ধের প্রায় সতের বছরের এক মেয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে। গরিব মানুষ। পুলিশের ভয়ে ও নিজের দুর্নামের ভয়ে থানায় আসছিলো না।
এই নিহত ঠাকুর সাহেব তাকে থানায় নিয়ে আসে। আমি মেয়ের লাপাত্তা হওয়ার রিপোর্টও লিখেছিলাম। আইনের চোখে মেয়ে ছিলো অপ্রাপ্ত বয়স্কা। মামলা নেয়া ও সে অনুযায়ি ব্যবস্থা নেয়া অত্যাবশ্যক।
রিপোর্ট লেখার পর জিজ্ঞেস করেছিলাম, মেয়ে কি সুন্দরী ছিলো? আর তার চালচলন কেমন ছিলো?
ঠাকুর জানালো খুব সুন্দরী ছিলো না। তবে স্বাস্থ্য খুব সুন্দর ছিলো।
মেয়ের বাবার সামনে ঠাকুর বললো, না, মেয়ের স্বভাব চরিত্র ভালোই ছিলো। কিন্তু এক ফাঁকে বৃদ্ধকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে বললো ভিন্ন কথা।
আসলে ঐ বুড়োকে খুশি করার জন্য বলে ছিলাম। তার মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে। ঠাকুর তখন বলেছিলো- এরা মজুরী করে খেটে খাওয়া লোক। এদের মেয়েরা যৌবনে পৌঁছার আগেই প্রেমপ্রীতি শুরু করে দেয়। ঐ মেয়ে নিজেই ভেগেছে। আপনি এ নিয়ে বেশি ছুটাছুটি করবেন না। দেখবেন, মেয়ে নিজে নিজেই কোথাও গিয়ে উপস্থিত হয়েছে।
আমি ঠাকুরের কথায় তখন প্রভাবান্বিত হয়নি তেমন। কারণ, এসব ঠাকুর, বড় বড় জমিদার জায়গীরদাররা ছোট ঘরের লোকদের মানুষ বলে মনে করে না। গরিব ঘরের মেয়েদের এরাই নষ্ট করে। তারপরও আমার মনে হলো ঐ মেয়ে নিজ ইচ্ছায় লাপাত্তা হয়েছে।
তবুও এ কেসের ভার থানাকে নিতে হবে। ইনস্পেক্টরের ব্যক্তিগত ধারণা এতে কার্যকরি হবে না। তাই সাব ইনস্পেক্টর বিশ্বনাথকে এ দায়িত্ব দিয়েছিলাম। সে তদন্ত করছিলো। আজ এজন্য বিশ্বনাথ সে কেসের কথা স্মরণ করিয়ে দিলো।
ঠাকুরের নিহত হওয়ার সঙ্গে ঐ মেয়ের লাপাত্তা হওয়ার সম্পর্ক না থাকলেও এটা মাথায় রাখলে ভালো হবে যে, সে গ্রামের এক মেয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছো বিশ্বনাথ আমাকে পরামর্শ দিলো।
আমারও মনে হলো ঠাকুরের নিহত হওয়ার সঙ্গে ঐ মেয়ের কোন সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। কারণ, ঠাকুর নিজেই মেয়ের বাপকে জোর করে থানায় নিয়ে এসেছিলো।
***
ঠাকুরের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, সেখানে চার দিকে লোকের মাতম। ঠাকুরের স্ত্রী ঠাকুরের চেয়ে তিন চার বছরের ছোট হবে। চুল সাদা হতে শুরু করেছে। ছেলে যা বলেছিলো ঠাকুরের স্ত্রী তাই বললো। তার মতে ঠাকুর সেই বাগান বাড়ি থেকেই কিছু একটা খেয়ে এসেছে।
আমার মাথায় আরেকটা চিন্তা এলো। রাতে ঠাকুর বাগান বাড়ি থেকে এসেছে এটা তো তাদের অনুমান। এমনও হতে পারে, ঠাকুরকে কেউ অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে বিষ খাইয়েছে।
ঠাকুরের স্ত্রী জানালো, তাদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক সহজ ছিলো। ঘরে কোন ঝগড়া বিবাদ ছিলো না। সে নিশ্চিত গ্রামের কারো সঙ্গে তার বিরোধ ছিলো না।
ঠাকুরের স্ত্রী কথায় আমি আস্থা রাখতে পারছিলাম না। কারণ, স্বামীর মৃত্যু তাকে বেহাল অবস্থা করে দিয়েছে। দু একটা কথা বলেই সে কেঁদে কেঁদে উঠছিলো।
আমি বাগান বাড়িতে চলে গেলাম। ছয় সাত একর জায়গা জুড়ে বাগানটি। ঘন গাছ গাছালিতে সুন্দর সাজে পরিপাটি করে রাখা। ভেতরের বাড়িটি খুব বড় না। বড় বড় দুই কামরা বিশিষ্ট। সামনে প্রশস্ত উঠোন আছে এবং চারদিক পাচিল ঘেরা। বাগানে তিনজন মালি কাজ করে। বাগানের পাশেই তাদের যার যার সংসারের ঝুপড়ি।