ইকবাল আবার বলতে শুরু করলো- দুদিন পর আবার আমাদের বাড়িতে পীর সাহেব এলেন। যারিনাকে কাছে বসিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বললেন, বড় বিষ ছায়া পড়েছে তার ওপর। পীর সাহেব তখন আমাকে ঘর থেকে বের করে দেন। তাদের মধ্যে কি কথাবার্তা হয় সেটা আজো পর্যন্ত জানতে পারি নি আমি। পীর যারিনাকে আরেকটি তাবিজ পানিতে গুলিয়ে পান করান এবং চলে যান……
আমি নিয়মিত পীর সাহেবের দরবারে সালাম জানাতে থাকলাম। পীর সাহেব বলতেন, মেয়ের ওপর যে তাবিজ করা হয়েছে এর আছর যতদিন থাকবে ততদিন ঐ মেয়ে কাউকে স্বামী বলে মেনে নেবে না। আমি উনাকে খুশী করতে বহু চেষ্টা করে বললাম, যেভাবেই হোক এই আছর আপনি দূর করে দিন। তিনি বলতেন, দূর হয়ে যাবে, তবে সময় লাগবে……
এর কিছু দিন পরই যারিনা লাপাত্তা হয়ে যায়। আমি ছুটে পীর সাহেবের কাছে গেলে তিনি বললেন, আমিও এই ভয় পাচ্ছিলাম। তার ওপরের ছায়াটা বড় ভয়ংকর ছিলো। সেটাই তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আমি বললাম, ইয়া পীর ও মুরসিদ! ওকে ফিরিয়ে আনুন।
পীর সাহেব বললেন, এখন যদি ও ফিরে আসে তাহলে তোমার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। সে তোমার স্ত্রী হবে না তখন কোনদিন। আর ওকে খুঁজতে যেয়ো না কোথাও। থানায়ও যেয়ো না। তাহলে কিন্তু সবাই মারা পড়বে।
তাহলে থানায় আসলে কেন?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।
আমার বাবা ও যারিনার বাবা আমাকে নিয়ে এসেছে। আমি এজন্য চুপচাপ ছিলাম যে, আমার পীর ও দস্তগীর আমাকে নিষেধ করেছেন থানায় আসতে।
তুমি কি বউ ফিরে পেতে চাও?
কি করবো ওকে নিয়ে? পীর সাহেবের শক্তিতে যদি আসে তাহলে তো খুব ভালো। আর আপনি যদি ওকে কারো কাছ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন তাহলে ও আমার কি কাজে লাগবে?
ইকবালের কথায় পীরকেও এই মামলায় সন্দেহভাজনদের তালিকায় নিয়ে এলাম। কিন্তু এখনই তাকে ঘাটাতে চাইলাম না। কারণ, পীর এতো কাঁচা লোক নয় যে সহজে আমার জালে জড়িয়ে যাবে।
আগে আমাকে সাক্ষীর জাল বুনতে হবে তারপর পীরকে জাল দিয়ে ধরতে হবে। কিন্তু এখন আমার চিন্তার বিষয় হলো, যারিনা কাকে পছন্দ করবো সেটা আগে খুঁজে বের করা।
***
পরে তিনদিন আমি আর এই মামলার দিকে মনোযোগ দিতে পারলাম না। হত্যার এক মামলায় সেশন কোর্টে আমি সাক্ষী ছিলাম। দ্বিতীয় দিনও আরেকটি মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তৃতীয় দিন থানারই অন্য আরেক কাজে ব্যস্ত ছিলাম।
সেশন কোর্ট আমার থানা থেকে আঠাশ মাইল দূরে। কিদার নাথ শির্মা নামে সেশন কোর্টের এক পি,পি (সরকারী ওকিল) এর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ট পরিচয় ছিলো। লোকটা এসব ব্যপারে অভিজ্ঞও খুব।
আমি শর্মাকে যারিনার ঘটনা শোনালাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম এমন কি হতে পারে, ঘুমের মধ্যে ঐ মেয়ে বাইরে চলে গেছে?
এমন হলে আশ্চর্যের কিছু নয় এটা- শর্মা বললেন- ঐ মেয়ে সমসময় চুপচাপ থাকতো। কে জানে ওর মনে কত কিছুই তো গোমট হয়ে থাকতে পারে। সে কিছু বলতো না এবং আবেগও প্রকাশ করতে পারতো না। সে থাকতো কল্পনার জগতে। এ ধরনের মানুষ ঘুমের মধ্যে কথা বলে অথবা উঠে চলা ফেরা করে। ঘুমের মধ্যে সে এমন জায়গায় যায় যেখানে জাগ্রত অবস্থায় যেতে পারে না। এটা একেবারেই মানসিক ব্যধি……..
আমার মনে হয়, ঐ মেয়ের পছন্দের বাইরে বিয়ে হওয়াতে সে তার স্বামীকে মেনে নিতে পারেনি। তবে স্বামীর ঘরে সে বন্দিনীর মতো ছিলো। এজন্য ঘুমের মধ্যে তার চলাফেরার রোগটি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। এবং সে রাতে বের হয়ে পড়ে, হয়তো ক্ষেত খামার দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলো। কেউ দেখে ফেলেছে এবং এমন রূপবর্তী মেয়ে হাতছাড়া না করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।
যদি পিপি কিদারনাথ শর্মার ধারনা মতে যারিনা হারিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এ মামলায় আমার জন্য সফল হওয়া একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমি এটা মাথায় রেখে যারিনার প্রেমিক কে তা খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার বিশ্বাস, যারিনা গেলে তার কাছেই গিয়েছে।
যারিনা গুম হয়েছে পাঁচ দিন চলে গেছে। থানায় বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদানকারী লোকজন ও থানায় আসা যাওয়া আছে দুই গ্রামের এমন প্রভাবশালী লোকদের কাছ থেকে যারিনা সম্পর্কে যে রিপোর্ট পাওয়া গেছে তার মুল কথা হলো, যারিনা অত্যন্ত ভালো সতী ৰাধী ও শান্ত মেজাযের মেয়ে।
যারিনার গ্রামের চৌকিদারের বউ স্বচ্ছল বাড়িগুলোতে কাজ করে। একেও আমি গোপনে খবর আদান প্রদানের জন্য লাগিয়ে রেখেছিলাম।
চৌকিদার তার বউ থেকে খবর নিয়ে আসে যে,
আব্বাস নামে যারিনার এক মামত ভাই আছে। তেইশ চব্বিশ বছরের মোটামুটি চেহারার এক ছেলে। ওর মা নেই। দুটি বোন আছে। ওরাই ঘর সামলে রাখে। যারিনাদের ঘরে আব্বাসের বেশ যাতায়াত ছিলো। যারিনার মাও তার ভাইয়ের ছেলে আব্বাসকে একটু বেশিই খাতির যত্ন করতো।
যারিনা অন্য কারো ঘরে যেতো না- চৌকিদার জানালো- ও শুধু ওর মামার বাড়িতেই যেতো। আমার বউ আগেও দেখেছে, যারিনা আব্বাসকে দেখে চমকে উঠতো। ওর সঙ্গে যত কথা বলতো অন্য কারো সঙ্গে এত কথা বলতো না। আব্বাসের বোনরাও যারিনার সঙ্গে বান্ধবীর মতো মিশতো। আমার বউ যারীনা ও আব্বাসকে একই খাটে বসা অবস্থায় দেখেছে।
আমি তখনই চৌকিদারকে তার স্ত্রী ও যারিনার মাকে নিয়ে আসতে নির্দেশ দিলাম। আমি এটা আদৌ মানতে পারছিলাম না যে, আব্বাস যারিনাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে তার বাড়িতে। এ ক্ষেত্রে ওদের মা বাবা কেউ এ অনুমতি দেবে নাযে, যারিনাকে বিবাহিতা অবস্থায় আব্বাস নিজের বাড়িতে রাখুক।