জাদুটোনা সম্পর্কে অনেকে অনেক কিছু বলে। কেউ একে বিশ্বাস করে আবার কেউ অস্বীকার করে। কিন্তু বিদ্যার অস্তিত্ব ও এর বাস্তবতা যে আছে এটা পরীক্ষিত সত্য। তবে এর প্রতিক্রিয়া ভালোমন্দ দুটোই হতে পারে।
কিন্তু অধিকাংশ মানুষই শত্রুর বিরুদ্ধে এটা ব্যবহার করে। এ ধরনের দুটি মামলা আমার কাছে অনেক দিন আগে এসছিলো। ইকবালের বিশ্বাস যে, যারিনা তার ঘরে আসার আগেই তাকে জাদু করেছে। এ কারণেই তার মতো টগবগে এক যুবক এক মেয়ের সামনে বরফ হয়ে গেছে। ওর মাথায় যারিনার বিরুদ্ধে আর কিছুই খেললো না।
সেই কথা বলে যাচ্ছিলো আর আমি অধৈৰ্য্য হয়ে অপেক্ষা করছিলাম যে, সে শেষ এটা স্বীকার পর্যন্তরিনাকে যে হত্যা করেছে করবে বা সে নিজেই যারিনাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। সে এখন তার পছন্দের লোকের কাছে আছে।
আচ্ছা! তুমি কি শেষ পর্যন্ত জানতে পেরেছে। যারিনা কাকে ভালোবাসতো?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।
আমি অনেক জানতে চেষ্টা করেছি, এ তথ্য উদ্ধার করতে পারিনি। আর গ্রামের লোকেরা ওকে অত্যন্ত ভালো মেয়ে বলে জানে- ইকবাল বললো।
তোমাদের এখানে থাকাকালে কোন রাতে কি এমন হয়েছে যে, যারিনা বিছানা থেকে উঠে এমনিই বাড়ি ঘর ঘুরে ঘুরে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছে?
না জনাব!- ইকবাল সবিস্ময়ে বললো- এমন তো কখনো হয়নি? আপনি একথা কেন জিজ্ঞেস করছেন?
আমি এ প্রসঙ্গে এড়িয়ে গেলাম। যারিনার গুম হওয়ার ঘটনা এর সঙ্গে কতটুকু সম্পৃক্ত- এ বিষয়ে আমি নিজেই অস্পষ্টতার মধ্যে ছিলাম।
***
কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার শুরু করলাম। ওকে সহজে ছেড়ে দিলাম না। ওকে শক্ত জেরা করলাম, সে যারিনার বিরুদ্ধে কিছু একটা অবশ্যই করেছে। ওকে শক্ত করে জেরা করলাম, সে যারিনার বিরুদ্ধে কিছু একটা অবশ্যই করেছে।
আমার মধ্যে নতুন এক মানসিক ব্যধি দেখা দিলো- ইকবাল এবার আরো সরল কণ্ঠে বললো
আমি কাউকে কিছু বলতে লজ্জা পেতাম। যারিনার ওপরও কোন জোর খাটালাম না। ছয় সাত দিন পর আমি আমাদের পীর সাহেবের কাছে গেলাম। তার পায়ে মাথা রেখে কেঁদে কেঁদে তাকে বললাম, আমার স্ত্রী অন্য কারো বশ মেনে নিয়েছে। এজন্য সে আমাকে স্বামী বানাতে আগ্রহী নয়। আর সে আমার ওপর এমন তাবিজ করেছে যে, ওর সামনে আমি কিছুই বলতে পারি না।
পীর সাহেব বললেন, ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি বললাম, ইয়া পীর দস্তগীর! সে কখনো আসবে না। সে বুঝে ফেলবে, আমি ওর মনকে ওর প্রেমিকের কাছ থেকে ছিনিয়ে আমার অধীনে নিয়ে আসতে যাচ্ছি। পীর সাহেব বললেন, ঠিক আছে, ওকে আনতে হবে না। আমিই তোমাদের ঘরে চলে আসবো…….
সেদিন সন্ধ্যায় পীর সাহেব আমাদের ঘরে এসে হাজির। আমি তো আনন্দে গদগদে হয়ে গেলাম। আমার সৌভাগ্যের দরজা খুলে গেছে। আমার পীর আমার ঘরে চলে এসেছেন। তিনি যারিনাকে এটা টের পেতে দিলেন না যে, তারই মাথা ঠিক করতে তিনি এসেছেন।
তিনি যারিনার মাথায় হাত রেখে তাকে পাঁচ টাকা সালাম দিয়ে বললেন, আমি চিল্লায় বসেছিলাম। তাই এতদিন পর নব দুলহানকে মোবারকবাদ ও সালামী দিতে এসেছি। তিনি কিছু একটা পড়ে যারিনার সারা দেহে ফুঁক দিলেন এবং যারিনাকে আরেকটু কাছে নিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বললেন, তোমার চোখে আমি তোমার দুশমনের ছায়া দেখতে পাচ্ছি।
যারিনা কিছুই বললো না। পীর সাহেব একটি তাবিজ লিখে পানিতে মিশিয়ে যারিনাকে খাইয়ে দিলেন। তিনি যারিনাকে অনেক ভয় দেখালেন, শত্রুর এই ছায়া কখনো কখনো অনেক ভয়াবহ রূপ নিয়ে থাকে……
পীর সাহেব যারিনার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। রাতে যারিনা আমাকে বললো, পীর সাহেবকে যদি তুমি ডেকে এনে থাকো, তাহলে তার তাবিজ আমার কিছুই করতে পারবে না। আমি মিথ্যা বললাম, না পীর সাহেবকে ডাকিওনি এবং তার সঙ্গে আমার কোন কথাও হয়নি।
সে কি তোমার সঙ্গে রাগ দেখিয়ে কথা বলতো? ঝগড়া বিবাদ করতো? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
না জনাব! অনেক শান্ত ও মার্জনীয় ভঙ্গিতে কথা বলতো।
ইকবাল যে পীরের কথা বলেছে, সে পীরের কাছে তাদের পুরো বংশ ও এলাকার সবাই তার মুরিদ। হেন কাজ নেই যা পীরের খানকায় ঘটে না। তার এক জোয়ান ছেলে আছে। খেয়ে খেয়ে অপদার্থ থেকে লাল মহিষে পরিণত হয়েছে। আমি যখন এই থানায় নতুন আসি তখন থানার এক হিন্দু আই. এস. আই আমাকে সতর্ক করে দেয় যে, পীরের ঐ ছেলে এক নম্বর মেয়ে শিকারী। কিন্তু পীরের ছেলে বলে লোকে চুপ থাকে।
একদিন নিজ এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে সেই পীরের আস্তানায়ও ঢু মেরে আসি। আগের থানা অফিসারের সঙ্গে পীরের খুব দরহম মরহম ছিলো। পীর আমাকেও সে ধরনের অফিসারই মনে করলো। আর আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে লাগলো। যেন এ এলাকার হুকুমত তার হাতে।
আমি আর তাকে বেশি বাড়তে দিলাম না। তার কানে বোমা ফাটিয়ে দিলাম। পরিস্কার ভাষায় বলে দিলাম, এই এলাকার হাকিম আমি এবং সে তার ছেলেকে যেন লাগাম পরিয়ে রাখে। পীর সাহেব প্রথমে তার মৃত পূর্ব পুরুষদের ক্রোধাৰিত আত্মার ভয় দেখালো। কিন্তু তার মাথা থেকে হুকুমতের ভূত আর শাহেনশাহী আমি নামিয়ে দিলাম।
এই ছেলেটি আমার বড় বেততমিজ হয়ে গেছে- পীর তখন আপসরফার সুরে বললো- আমার নিজের ঘরও তো তার হাত থেকে নিস্তার পায় না। আপনাকে সত্য করে বলছি, এই ছেলের সঙ্গে আমার কথা বার্তাও বন্ধ। আমার ও গদির মান সম্মানের ব্যপারে না হলে ওকে আমি অনেক আগেই ঘর থেকে বের করে দিতাম।