চৌকিদার আমাকে জানালো, ইকবাল খুব প্রাণোচ্ছল ছেলে ছিলো। কিন্তু বিয়ের পর তার ঠোঁটে হাসি দেখা যায়নি।
যা হোক, যারিনা বাবা, ইকবালের বাবা ও ইকবালকে আমি থানায় নিয়ে আসলাম। কেউ হারিয়ে গেলে তার মামলা নেয়ার আগে অনেক লেখালেখি করতে হয়। তারপর অন্যান্য থানায়ও হারানো ব্যক্তির নাম ঠিকানা আকার আকৃতির বর্ণনা সম্বলিত রিপোর্ট পাঠাতে হয়। রিপোর্ট লেখককে আমি এ কাজে লাগিয়ে দিলাম। আর অন্যদের বিদায় করে ইকবালকে আমার সামনে বসালাম।
***
তুমি যদি এখনো আমাকে কিছু না বলে তাহলে আমি বলবো, তোমার বউ তোমাকে পছন্দ করতো না। আর তুমি তাকে হত্যা করে লাশ কোথাও চাপা দিয়ে রেখেছে আমি ইকবালকে ভীতি ধরানো গলায় বললাম
তোমার নিরবতা আমার সন্দেহ ক্রমেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। তুমি দেখেছে, তোমাদের এলাকার কত লোকের সাথে আমি কথা বলেছি। এরপর তোমারাও যারিনার মাও তো আমাকে কিছু কথা বলেছে। তুমি শুধু আমাকে এতটুকু বলল, বিয়ের আগে তুমি এত সজীব প্রাণ ছিলে আর বিয়ের পর এত চুপসে গেলে কেন? এমন সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে তুমি কোন অসুখে পড়লে?
আমি ওকে হত্যা করিনি। হত্যা করলে তো বিয়ের প্রথম রাতেই করতাম। কোন ক্রুদ্ধ মূর্তি যেন ইকবালের ভেতর থেকে বলে উঠলো।
কেন? প্রথম রাতেই হত্যা করার কথা কেন মনে হলো?
তার বুক থেকে হাহাকার বেরিয়ে এলো। যেন সেখানে এক নদী দুঃখ জমাট বেধে আছে। তার মাথাটি সামনের দিকে নুয়ে পড়লো। আমি তাকিয়ে রইলাম। তারপর যখন মাথা উঠালো মনে হলো অনেক কষ্টে বড় এক বোঝা উঠাচ্ছে। চোখ গুলো রক্ত বর্ণ হয়ে উঠলো। তার সুন্দর মুখটা ছেয়ে গেলো বিমর্ষতার কালো ছায়ায়।
আমি দুর্বল ছেলে নই- যেন তাল হারানো গলায় কথা বলছে ইকবাল আর আমি জানতাম না, দুঃখ আর হতাশ কাকে বলে? আমার এলাকার মেয়েরা তো আমাকে তৃষ্ণকাতর নয়নে দেখতো। অথচ বিয়ের প্রথম রাতেই আমার নববধু আমাকে স্পষ্ট বলে দিলো, আমার কাছে আসবে না। আমি অন্তর থেকে তোমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করিনি। না, ভীত অনুতপ্ত গলায় সে একথা বলেনি। বড় স্পর্ধিত গলায় হুকুমের সুরে বলেছিলে। তোমার হাত দুটি পেছনে রাখো…
বিয়ের আগে আমাকে সবাই বলেছে, তুমি যে বউ পাচ্ছো সে এতই চুপচাপ থাকে যে, লোকে তাকে বোবা বলে। অথচ সে বোবা মূক মেয়েটি আমাকে বোবা বানিয়ে দিলো। লোকে যে আমাকে নির্ভীক সাহসী ছেলে বলে জানতে আমার সেই নির্ভীকতা কোথায় যেন চলে গেলো। আমি টলমলে পায়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার মন মগজ সব আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। যে ছেলে নিজেকে শাহজাদা মনে করতো। মেয়েরা যার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়ে যেতো। তাকে এক মেয়ে বলছে, আমার কাছে আসবে না। সে তো বরফের সঙ্গে গলে পানি হয়ে যাবে। অথবা আগুনের স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠবে। না হয় সে আত্মহত্যা করবে বা বিপক্ষকে গলা টিপে মারবে। আমার মনে হলো, আমি বরফের মতো গলে গলে পানি হয়ে যাচ্ছি…..।
কথা বলার মতো কোন শক্তি আমার মুখে জোগলো না। সে ভেবেছে, আমি রাগ সামলাতে গিয়ে কথা বলতে পারছি না। সে বললো, তুমি পুরুষ আমি দুর্বল এক মেয়ে। আমাকে মারো, খুন করো, কিন্তু তোমার স্ত্রী হবো না। তুমি জোর করে স্ত্রী বানাতে চাইলে তোমার সঙ্গে লড়াই করে পারবো না আমি। কিন্তু মনে রেখো, তোমার বিরুদ্ধে এমন অপবাদ ছড়িয়ে দিবো যে, সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না……।
আমি জানাতাম, মেয়েরা যদি বদনাম রটিয়ে দেয়, আমার স্বামী পৌরষত্বহীন তাহলে সে পুরুষ আর কারো সামনে মুখ খুলতে পারে না। ওকে অমি অনেক কিছু বললাম। বুঝলাম যে, সে বিয়ের শুরুতেই কেন অস্বীকার করলো না। এখন তো সে আইন সম্মত স্ত্রী।
সে বললো, আমি পালাবো না। তোমার ঘরেই থাকবো, কিন্তু স্বামী স্ত্রীর কোন সম্পর্ক রাখবো না।
এতক্ষণ সে ঘোমটা মুখে রেখেই কথা বলছিলো। তারপর সে তার মুখের ঘোমটা সরালে। রূপের এক তীব্র ধাক্কায় যেন আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সাধারণ চেহারার কেউ হলে না জানি আমি কি করতাম। কিন্তু ওর রূপ আমাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিলো…..।
আমি ওকে বললাম, আমি তো এত কুৎসিত নই যে, আমাকে দেখে তোমার ঘৃণা উপচে পড়ছে। সে বললো, কে বলেছে তোমাকে আমি ঘৃণা করছি। তুমি তোমার এলাকার শ্রেষ্ঠ রূপদর্শন ছেলে। তোমাকে দেখে যে কোন মেয়ের মনে শিহরণ জাগবে। কিন্তু তুমি আমাকে যেভাবে গ্রহণ করেছে আমি তোমাকে সেভাবে গ্রহণ করতে পারিনি। যদি আমাকে তালাক দিয়ে দাও তোমার ওই অনুগ্রহ সারা জীবনেও আমি ভুলবো না….।
আমি একথার কোন জবাব দিলাম না। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, সেই ভাগ্যবান কে যার কারণে তুমি আমার পৌরুষত্বে লাথি মারছো?
সে বললো, এটা তো আমি কখনেই বলবে না…… নরক বাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমার রাতটা কাটলো। সকাল বেলা মনে হলো সমস্ত দুনিয়া আমার চোখের সামনে দুলছে।
তুমি কি তোমার মা বাবাকে এসব কথা জানাওনি?
না, জানাইনি। যদি এর কারণ জিজ্ঞেস করেন আমি কোন সদুত্তর করতে পারবো না। মনে হচ্ছিলো ঐ মেয়ে যেন আমাকে বশীকরণ তাবিজ করেছে। আপনি পুরো গ্রামে জিজ্ঞেস করেন। আমি কেমন সাহসী ছেলে ছিলাম। কিন্তু ঐ মেয়ের সামনে আমার সব বীরত্ব উধাও গলো। বন্ধুরা ঠাট্টাচ্ছলে রসিকতা করে আমাকে জিজ্ঞেস করে, প্রথম রাত আমার কেমন কেটেছে। আমি বড় কষ্টে জবাব দেই, ভালো কেটেছে।