***
যারিনার মা খুব কাঁদছিলেন। মা হিসেবে মেয়ে হারানোর আঘাত সওয়ার মতো অবস্থা তার ছিলো না। কিছু সান্ত্বনা বাণী শুনিয়ে তাকে আমি শান্ত করলাম।
আপনার মেয়েকে ফিরে পেতে চাইলে মেয়ে সম্পর্কে কোন কথাই গোপন রাখবেন না। আমি একটু জোরের সঙ্গে বললাম। প্রথম কথা হলো, সে কোথায় এবং কার সঙ্গে গিয়েছে এ সম্পর্কে এক আপনার কোন ধারণা আছে?
আল্লাহর কসম সামনে রাখুন। আমার মাথার ওপর কুরআন শরীফ রেখে দিন- যারিনার মা ত্রস্ত গলায় বললেন, কারো সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার মেয়ে না আমার যারিনা। নিরবে বসে আল্লাহকে স্মরণ করা মেয়ে সে।
ইকবালের সঙ্গে বিয়ে হওয়াতে সে কি খুশি ছিলো?
না জনাব! আমি সত্য সত্য বলছি সে খুশি ছিলো না।
কি বলতে যারিনা? ইকবাল ভালো নয় এসবই তো মনে হয় বলতো।
প্রথম প্রথম বলতো, আমাকে বিয়ে করাবেন না। অন্যের ঘরে আমি সুখী হতে পারবো না। আমি ওকে অনেক বুঝিয়ে বললাম, ইকবাল এত সুদর্শন যুবক। ওর সঙ্গে তুমি সুখী হবে। তখন বললো, আমাকে ইকবালের সঙ্গে বিয়ে দেবেন না। কারণ জিজ্ঞেস করলাম, ও বললো, বিয়ে শাদীকে আমি ভয় পাই। তখন আমি মনে করেছি, অল্প বয়সী মেয়ে বলে বিয়ের কথা শুনে ঘাবড়ে গেছে।
আপনার কি মনে হয় মাজ্বী! আমি জিজ্ঞেস করলাম- সে কি ইকবাল পছন্দ করতো না? তাহলে কাকে পছন্দ করতো?
ইকবালকে পছন্দ করতো না এমন নয়- যারিনার মা জবাব দিলেন- আপনি ইকবালকে দেখেছেন। যেকোন মেয়েই ওকে পছন্দ করবে…. ঘরের বাইরে আমার মেয়ের কোন আগ্রহ ছিলো না, অন্যান্য যুবতী মেয়েদের মতো সে কাউকে সই সখিও বানায়নি। না, সে আর কাউকে পছন্দ করতো না। আমি কসম খেতে পারবো এ ব্যাপারে।
কসমের কথা বলবেন না মাজী! আমি তাকে থামিয়ে দিলাম। কেউ কারো মনের খবর জানে না,….. ওর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা হয়তো ওকে কষ্ট ক্লেশে যন্ত্রণা দিতো। এ কারণে সে ভয়ে পালিয়েছে।
সে পলিয়ে যাবে কোথায়? নিজের ঘরেই ফিরে আসতো। তাছাড়া এক মাসে সে দুই তিনবার আমার কাছে আসে। আমি ওর শ্বশুর শাশুড়ি ও ইকবালের আচার ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি। সে কোনদিন কোন অভিযোগ করেনি।
মাজী! আমার গলা দৃঢ় হয়ে গেলো- আপনার মেয়েকে আমি কোথাও না কোথাও থেকে বের করে আনবো। কিন্তু এর আগে ওর বান্ধবীদের কাছ থেকে আমি জেনে নেবো যে, সে কাউকে না কাউকে পছন্দ করতোই। নিজের ইচ্ছাতেই সে গিয়েছে। কেউ ওকে উঠিয়ে নেয়নি।
মহিলা চিন্তায় পড়ে গেলেন। আমি তার চোখমুখ জড়িপ করতে লাগলাম। মহিলা বেশ অভিজাত ঘরের। তাই তার বার্তার ধরনও ছিলো বেশ মার্জিত।
আপনি বলছেন ও নিজ ইচ্ছাতে গিয়েছে। মহিলা আহত গলায় বললেন, একথায় আমি দুঃখ পেয়েছি, এটা একেবারে ভুল। তবে আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। সেটা হলো, যারিনার ঘুমের মধ্যে চলা ফেরার অভ্যাস ছিলো। কিন্তু…. কিন্তু আমি আর কিছু বলতে পারছি না।
ঘুমের মধ্যে চলা ফেরা করতো? আমি চমকে উঠলাম- ঘুমের মধ্যে কি সে ঘরের বাইরে চলে যেতো?
এক সঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন আমার জিহ্বার ডগায় এসে ভিড় করলো। যা আমি কোন বিরতি ছাড়া এক নিঃশ্বাসে জিজ্ঞেস করলাম। যারিনার মা আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যেন আমাকে বেকুব ঠাওরাচ্ছেন। তিনি নিশ্চয় ভাবছেন, আরে ওই বেকুব এমন করছে কেন? অবশ্য এই হতভম্ব চোখেই আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
অনেকে অবশ্য জানেন, ঘুমের মধ্যে চলা ফেরা করার ওই রোগ সাধারণত শিশুদের হয়ে থাকে। অনেক শিশু আছে, যারা ঘুমের মধ্যেই বিছানা থেকে উঠে, ঘরে বা বারান্দায় ঘুরে ফিরে এসে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে। এই ঘোরা ফেরার সময় চোখও খোলে না। সকালে উঠে তার আর কিছুই মনে থাকে না। এটা এক প্রকারের মানসিক রোগ।
যারিনার মা জানালো। যারিনাও মাসে দুএকবর মাঝ রাতে উঠে চলা ফেরা করতো। ঘরের কেউ জেগে উঠলে তাকে বাধা দিতো। তখন তার কোন অনুভুতি হতো না যে, তাকে কউ হাটা চলা ফেরা করতে বাধা দিচ্ছে। আঙ্গিনায় বা বারান্দায় ঘুরে সে আবার ফিরে আসতো। দুবার সে বাড়ির ওপর তলার দিকেও উঠে পড়েছিলো। তার ভাগ্য ভালো, দুবারই তার মা তাকে দেখে ফেলে এবং তাকে নিচে নিয়ে আসে। তার চোখ তখন অর্ধেক ভোলা থাকতো।
বিয়ের পাঁচ ছয় মাস আগ থেকে এ রোগ দেখা দেয়। অর্থাৎ তার তের চৌদ্দ বছর বয়সে এ রোগ দেখা যায়।
তার মা বাবা এ রোগের চিকিৎসা করান নানা তাবিজ কবজ ও খানকা শরীফের মাটি দিয়ে।
তাদের এটা জানা ছিলো না যে, এ হলো মস্তিস্কের অসাড়তা। এ এমন এক মানসিক রোগ বা তাবিজ কবজ বা সাধারণ চিকিৎসা ভালো হয় না। ওর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা এই অসুখের কথা জানতো?
না জনাব- যারিনার মা বললেন- বললে তো আত্মীয়তা করতে ওরা রাজি হতো না।
যারিনার মাকে নিয়ে আমি অনেক সময় ব্যয় করলাম। তাকে বার কয়েক বললামও, তার মেয়ে অন্য কাউকে ভালো বাসতো। তারা যেন তাকে খুঁজে বের করে। কিন্তু মাহিলা অস্বীকার করে বলেন, এমন কেউ আছে বলে তার জানা নেই। আমার মাথায় যারিনার ঘুম রোগ আটকে যায়।
তারপর আমি সেখানকার চৌকিদার নৈশপ্রহরী ও দুইজন অভিজাত লোককে থানায় ডাকিয়ে এনে বললাম,
তোমাদের এলাকার একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে। তোমাদের তাই বসে থাকা উচিত হবে না। তারা যেভাবেই হোক চার দিক যেন খোঁজে বেড়ায়। যারিনার স্বভাব চরিত্র কেমন, কারো সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিলো কিনা এসব যেন খুটে বের করে আমাকে এসে জানায়।