স্বামী স্ত্রীর খাট দুটি পরস্পরে সঙ্গে লাগানো ছিলো। আর বাড়ির চার দেয়ালও এত উঁচু যে, সাধারণভাবে সেটা টপকে ভেতরে যাওয়া সহজ নয়। ছাদ দিয়েও ভেতরে ঢোকা মুশকিল হবে। এ ঘর থেকে একমাত্র পেশাদার ডাকাত ছাড়া অন্য কেউ জলজ্যন্ত একটা মানুষ উঠিয়ে নিতে পারবে না।
আমার মনে আরেকটা সন্দেহ উঁকি দিলো যে, যারিনার স্বামী ইকবালও তো কোন কারণ যারিনাকে হত্যা করতে পারে। তারপর লাশ কোথাও ফেলে আসতে পারে।
কিন্তু এই সন্দেহ এজন্য কাঁচা যে, ইকবাল যারিনাকে হত্যা করে লাশ কোথাও ফেলে আসলে কোথাও না কোথাও থেকে লাশ পাওয়ার খবর আসতো। অবশ্য লাশ দাফনও করে দিতে পারে। ইকবালের ওপর আমার সন্দেহ আরেকটা কারণ ছিলো। সে সবসময় চুপ চাপ। ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে এখানে আসে। সব কথার জবাব তার বাবাই দিচ্ছিলেন।
জনাব, ইকবালের বাবা বললেন, আমার ছোট মাথায় একটা কথা এসেছে, যারি না যদি নিজেই যেতো তাহলে সঙ্গে করে সোনাদানা টাকা পয়সাও নিয় যেতো।
আমি কথাটাকে জরুরী মনে করলাম না। ওর পরকীয়া সম্পর্ক এমন লোকের সঙ্গেও হতে পারে যে বেশ ধনাঢ্য। তার সোনাদানার প্রয়োজন নেই।
যা হোক, এসব কথা এখনই আমার জানা জরুরী নয়। আর যারিনার শ্বশুরের পরামর্শ আমার এজন্য প্রয়োজন নেই যে, তার নাক কাটা গেছে এবং সেখানে এখন মাছি বসেছে। কারো ঘর থেকে নববধূর পালিয়ে যাওয়াটা বড় দুর্নামের বিষয়। আমার কাছে এমন অনেক মাধ্যম আছে যার দ্বারা মাড়ির নিচের গোপন বিষয়ও আমার জানা হয়ে যায়।
এখানে আরেকটা দিক আছে, এ ঘটনা যে সময়ের সে সময়টা আজকের তুলনায় অনেক পবিত্র ছিলো। মানুষের মধ্যে আদর্শ আর নীতিবোধ বিপুলভাবে জাগ্রত ছিলো। ছেলে মেয়ের অবাধ মেলা মেশা ছিলো অকল্পনীয় ব্যাপার। লজ্জা ও শ্লীলতা ছিলো সমাজের ভূষণ। তাই কোন বাড়ি থেকে কোন মেয়ের উধাও হয়ে যাওয়াটা যেমন বিস্ময়কর ব্যাপার ছিলো তেমনি ছিলো দুঃসাহসের ব্যাপার।
আমি ইকবালকে পৃথকভাবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। তাকে সতর্ক করে দিলাম, হয় সে নিজে বলবে না হয় অন্যদেরকে আমি জিজ্ঞেষ করে জেনে নেবো আসল ঘটনা কি? তবুও ওর জবাব আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারলো না। ওকে বিদায় করে ওর মাকে নিয়ে বসলাম।
না-জ্বি: আমি পরিষ্কার ভাষায় বললাম, এখন আর নিজের সম্মান অসম্মানের কথা মনে রাখবেন না। এসব বিষয় যখন পুলিশের হাতে চলে যায় তখন আর কোন কিছুর পরওয়া থাকে না। আপনার বউ যে নিজে ইচ্ছায় গিয়েছে। এটা নিশ্চিত। কোন দুশ্চিন্তা না কর আমাকে সব কথা খুলে বলুন। সবার আগে বলুন, মেয়ের স্বভাব চরিত্র কেমন ছিলো? চাল চলন কেমন ছিলো? আপনার ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোন ধরনের ছিলো? এমনকি ঘরের অন্যদের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিলো তার? চঞ্চল বুদ্ধিমান ছিলো, না সরলা- লাজুক ছিলো?
ওর দুটি গুণ দেখে আমরা আত্মীয়তা করি- ইকবালের মা বললেন, একটা হলো তার রূপ। আরেকটা হলো তার শান্ত স্বভাব। ওদের বাড়িতেও সে স্বল্প ভাষী ছিলো। নামায রোযার প্রতিও খুব যত্নশীল।
সবসময় খুব যত্নশীল।
সবসময় কি উধাস উধাস মন মরা থাকতো
না, হাসি খুশি থাকতো
আর আপনাদের বাড়িতে
এখানেও চুপচাপ থাকতো
আর হাসি খুশি?
ইকবালের মা চিন্তায় পড়ে গেলেন। চিন্তামুক্ত কণ্ঠে বললেন, ওদের বাড়ির মতো এখানে হাসি খুশি থাকতো না।
আর ইকবালের সঙ্গে?
নতুন বউ এর ব্যাপার তো জানেনই। বিয়ের পর যারিনা আমাদের সামনে সব সময় ইকবালের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পেতো। এজন্য ওদেরকে কখনো কথাও বলতে দেখিনি।
এমন সুন্দরী বউ পেয়ে ইকবাল নিশ্চয় অনেক খুশি? আমি ধারালো গলা জানতে চাইলাম। আমি সঠিক জবাব চাই। ভেবে চিন্তে বলবেন। এতে হয়তো জানা যাবে- যারিনা নিজ ইচ্ছায় গিয়েছে না কেউ উঠিয়ে নিয়ে গেছে।
আমার ছেলেকে খুব খুশি মনে হতো না- ইকবালের মার হতাশ কষ্ট, আমার ছেলে তো বড় হাসিখুশি ফুর্তিবাজ ছেলে ছিলো। কিন্তু বিয়ের পর তার মুখের হাসি যেন কে কেড়ে নিয়েছে।
যদি জিজ্ঞেস করি যারিনার সঙ্গে আপনাদের ব্যবহার কেমন ছিলো আপনি বলবেন খুব ভালো ছিলো, সত্য কথা বলবেন না।
আমি সত্য না বললে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। আমাদের প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করুন। যারিনার মাকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন। তবে ওকে প্রায়ই বলতাম, লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা কিছু একটা বলল, নইলে আশ পাশের লোকেরা তো বদনাম দেবে শাশুড়িকে।
তখন সে কি বলতো?
তখনো নিরব থাকতো- ইকবালের মা বললেন, বউ শ্বশুড়ির যুদ্ধ তো অতি প্রাচীন প্রবাদ। কিন্তু ও তো মুখই খুলতো না।
এই মহিলাকে নিয়ে আমি অনেক মাথা খাটালাম। এ থেকে এতটুকু পেলাম যে, ইকবাল ও যারিনার সম্পর্কের মধ্যে একটা কিন্তু ছিলো।
ইকবালের বাড়িতে যারিনা সুখী হতে পারেনি এবং ইকবালের মতো প্রাণচঞ্চল ছেলে বিয়ের পর একেবারে চুপসে যায়। আমি মাথায় এটাও টুকে রাখলাম যে, যারিনার শ্বাশুড়ি তাকে চাপের মধ্যে রাখতে কিংবা ছেলের কানভারী করে যারিনাকে তার হাতে মার খাওয়াতো। গ্রামাঞ্চলের লোকেরা এখনো পুত্র বধূকে মারপিট করে গর্ববোধ করে।
আরা অনেক কিছু জানার ছিলো আমার। ইকবালের বাড়িতে যারিনার মাও এসেছিলো। তাকে নিয়ে ইকবালের বাড়ির দেউরিতে বসে পড়লাম আমি।