আমি জিজ্ঞেস করলাম, মেয়ে লাপাত্তা হলো কি করে?
তারা জানালো, তাদের বাড়ি পাকা করা। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িই কাঁচা। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি সে তুলনায় পাকা তো বটেই, বড়সড় এক হাবেলি সেটা, উঠোনের দুদিকে দুই সারি ঘর। এক দিকের এক ঘরে রাতে গুম হওয়া মেয়ে যারিনা ও তার স্বামী ইকবাল শুয়েছিলো। ওরা ওই ঘরেই থাকে। ঘরের অন্যরা আরেকদিকের ঘরগুলিতে থাকে।
ভোরের আঁধার থাকতেই যারিনার শ্বশুর শাশুড়ি উঠে পড়েন। প্রতিদিন তারা এ সময়ই উঠেন। গাভী ও মহিষের দুধ দোহনের ব্যাপারে তদারকি করেন। সেদিনও উঠে দেউরীতে গিয়ে দেখেন সদর দরজা খোলা।
যারিনার শ্বশুর শাশুড়ির আগে এবাড়িতে আর কেউ উঠে না। দরজা খোলা দেখে শ্বশুর যারিনার কোঠায় গিয়ে দেখলেন, তাদের বউ যারিনা বিছানায় নেই। শ্বশুর শাশুড়িকে গিয়ে জানালেন। শাশুড়ি ভাবলেন হয়তো তাজা হাওয়া খেতে বাইরে গেছে। একটু পর চলে আসবে।
কিন্তু সকাল গড়িয়ে বেলা চড়ার পরও যারিনা ফিরলো না।
যারিনাদের বাড়ি সেখান থেকে দেড় মাইল দূরে। সেখানে গিয়েও তার কোন খোঁজ পাওয়া গেলো না, কোথায় খুঁজবে কোথায় যাবে কেউ কিছুই বুঝতে পারছিলো না। আশে পাশের বাড়িগুলোতেও খোঁজা হলো। অপেক্ষায় অপেক্ষায় দিনটি এভাবেই কেটে গেলো।
রাতে যারিনার বাবা ও শ্বশুর তাদের এলাকার পীরের কাছে গিয়ে হাজির হলেন।
পীর সাহেব নানা হিসাব কিতাব করে বললেন, মেয়ে তো অনেক দূরে চলে গেছে। ফিরেও আসবে। তবে চেষ্টা করতে হবে খুব। পীর সাহেব তাদেরকে এক মুঠি কালো মাসকেলাই- এর অর্ধেক থাকবে পেষা এবং আরো কয়েকটা জিনিস আনতে বললেন।
এসব জিনিস সময় মতো পীরকে দেয়া হলো।
পীর নিশ্চয়তা দিলেন, সন্ধ্যার দিকে মেয়ে উড়তে উড়তে চলে আসবে। যারিনার বাবা ও শ্বশুর পীরকে দ্বিগুণ নজরানা দিয়ে বিদায় হলেন।
যেমন আর্জেন্ট ছবি বা তাৎক্ষণিক ড্রাই ওয়াশ করতে হলে দ্বিগুণ মজুরি দিতে হয় তেমনি তারাও পীরকে বলে আসলেন, সন্ধ্যার আগে যদি মেয়ে ফিরে আসে ঝোলা ভরে পয়সা দিয়ে যাবেন দরবার শরীফে। যারিনার বাবা তো পীর সাহেবকে একটি বকরি দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দিলেন।
পরে যখন শুনলাম, ওদেরকে থানায় পাঠিয়েছে এক শিখ ভদ্রলোক তখন খুব আফসোস হলো পীরের জন্য। শিখ তাদেরকে পরামর্শ দেয়, আরে মিয়ারা বেওকুফী বন্ধ করে থানায় যাও। পুলিশকে ঘটনা খুলে বলো। এ সব পীর সাহেবরা মেয়েদের অপহরণ করতে পারবেন কিন্তু অপহৃত মেয়ে উদ্ধার করতে পারবে না।
যা হোক, উভয় পক্ষের অভিভাবকরা এ ঘটনা গোপন রাখার খুব চেষ্টা করে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে কোন কিছুর ওপর বেশি দিন পর্দা ফেলে রাখা সম্ভব নয়।
মেয়ে কি ঘর থেকে কিছু নিয়ে গেছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
না কিছুই নিয়ে যায়নি। আমরা খোঁজ করে দেখেছি। এসব নিশ্চিত হয়েই তো আমরা বলছি, আমাদের মেয়েকে অপরণ করা হয়েছে। শ্বশুর জবাব দিলেন তটস্থ হয়ে।
কারো সঙ্গে আপনাদের সঙ্গে শত্রুতা ছিলো?
না, জনাব! শ্বশুর বললেন, ছোট খাটো ঝগড়া ঝাটি তো একজনের সঙ্গে আরেকজনের হয়েই থাকে। হত্যা বা অপহরণ করার মতো শক্রতা তো কারো সঙ্গে নেই।
দেউরির দরজা কি ভেতর থেকে বন্ধ ছিলো?
খুব ভালো করে বন্ধ ছিলো। আমি নিজেকে শিকল লাগিয়ে ছিলাম, শ্বশুর বললেন।
আমাকে একটা কথা খুব ভেবে বলবেন, আমি বললাম, এমনও তো হতে পারে, অপহরণকারী বাড়ির দেয়াল টপকে ভেতরে বসেছে এবং আপনাদের মেয়েকে দরজা খুলে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।
আমি যারিনার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললাম, আচ্ছা, তুমিই বলো, তুমি তো শুইয়েই ছিলে, মৃত তো ছিলে না, তারা মেয়েকে উঠানোর সময় কমপক্ষে তো সামান্যতম শব্দ ও তো করবে, ধস্তাধস্তি চিৎকার চেঁচামেচি করবে। সে তো লাড়কিই ছিলো, লাকড়ি তো ছিলো না যে, কেউ এসে আরাম করে বয়ে নিয়ে চলে গেছে।
আমি জানি না সে কিভাবে গিয়েছে। স্বামী বেচারার গলা কেঁপে উঠলো। আমি আপনাদের সবাইকে বলছি মেয়ে নিজ ইচ্ছায় চলে গেছে- আমি প্রাথমিক ফয়সালা শোনালাম আমি আপনাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করি, মেয়ের চাল চলন কেমন ছিলো?
আপনারা বলবেন, মেয়ে বড় সতী স্বাধ্বী ছিলো। কিন্তু আমি বলছি ঐ মেয়ে তার স্বামী ইকবাল ছাড়া আরো অন্য কাউকেও পছন্দ করতো। তার গলা ধরেই মেয়ে হাওয়া হয়ে উড়ে গেছে। এখন হয়তো আপনারা বলে উঠবেন। সে তো ইকবালের জন্য জান কবুল মেয়ে ছিলো……..
আমি জানতে চাই, কে আপনাদের মধ্যে সত্য বলবেন?
তিনজনের কারো মুখ দিয়েই কথা বেরোলো না। যেন তাদের বাক শক্তি অসা হয়ে গেছে।
জনাব! আমরা তো এটাই বলবো যে, আমাদের মেয়ে এরকম ছিলো না। আপনি যে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। একেবারে চুপচাপ শান্ত মেজাযের ছিলো ঐ মেয়ে। নিরবতা ভেঙ্গে শ্বশুর বলে উঠলেন।
তারা মূল্যবান দুটা দিন সময় নষ্ট করে এখানে এসেছেন। তাই মেয়ে কি নিজেই চলে গিয়েছে না অপহৃত হয়েছে তা জানাটা এখন বেশ দুরূহ হয়ে গেছে।
আপনারা কি আপনাদের পীর সাহেবকে জানাননি যে, সন্ধ্যার পরও মেয়ে ফিরে আসেনি?
জানিয়েছিলাম জনাব! শ্বশুর বললেন, তিনি বলেছেন, মেয়ের ওপর কঠিন তাবিজ করা হয়েছে। ফিরে আসবে, তবে সময় লাগবে অনেক দিন।
***
যারিনার শ্বশুর বাড়ি অর্থাৎ ইকবালের বাড়িতে গেলাম আমি। বাড়ির বারান্দার দিকের যে ঘরে ইকবালরা থাকতো প্রথমে সে ঘরে গেলাম।