তখন ওর সঙ্গে সলা পরামর্শ করে ঠিক করলাম, দুলারীকে তার ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দেয়াই নিরাপদ। কারণ, ইংরেজরা ফৌজকে অনেক কদর করে। পুলিশ সে পর্যন্ত যেতে পারবে না। তবে দুলারীর ভাই নায়েক জগমোহন আমাকে বললেন, তুমি যে ঠাকুরকে বিষ দিয়েছো এটা আমার কর্ণেলকে জানানো যাবে না। তাহলে কর্ণেলই তোমাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে দেবে।
***
দুর্গার জবানবন্দির পর দুলারীর ভাইয়ের জবানবন্দি নেয়ার আর প্রয়োজন ছিলো না। তবুও আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার্থে নেয়া হলো তার জবানবন্দি। এসব ঘটনা আমি রিপোর্ট আকারে লিখে ঐ রেজিমেন্টের কর্ণেলকে শোনালাম। কর্ণেল ক্ষেপে গেলেন এ কারণে যে, তারা তার কাছে বিষের ঘটনা লুকিয়েছে।
এমনিতে কর্ণেল দূর্গার কৃতিত্বে খুশি ছিলেন। যেস এক অবলা নারীকে মৃত্যুপুরী থেকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু মিথ্যাচার তাদের কাছে অসহ্য।
যা হোক, কর্ণেলের পরামর্শে এবং সাক্ষ্যের খাতিরে দুর্গা, দুলারী ও তার ভাই জগমোহনকে নিয়ে রাতের মধ্যেই গাড়িতে করে আমাদের থানায় চলে এলাম।
সকালে দুর্গাকে নিয়ে ঐ সন্নাসীর ডেরায় অভিযান চালিয়ে তাকে থানায় নিয়ে এলাম। এক হিসেবে সন্নাসী আইনের চোখে অপরাধী নয়। কিন্তু ধোকাবাজ হিসেবে অবশ্যই অপরাধী।
সন্নাসীকে জিজ্ঞেস করলাম, ঠাকুরকে সে যে জাদু বিদ্যা দিয়েছে এতে কি সত্যিই মাথার হাড় দিয়ে লোহাকে সোনা বানানো যায়?
আমি কখনো পরীক্ষা করে দেখিনি- সন্নাসী জবাব দিলো- আমার উস্তাদ আমাকে শুধু এটা শিখিয়েছিলো। আমি শেখালাম ঠাকুর সাবকে। তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম, এমনভাবে সব দিক দিয়ে মিলিয়ে কোন মৃত মেয়ের হাড় কেউ আনতে পারবে না।
সন্নাসীকে ছেড়ে দিলাম। থানায় এসে পূর্ণ রিপোর্ট তৈরী করে ডিএসপি সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। ডিএসপি আমাকে ধন্যবাদ জানালেন।
তবে দুর্গার বদলে যাওয়া চরিত্র আমাকে মুগ্ধ করে দিলো। এক নিষ্পাপ মেয়েকে বাঁচানোর জন্য প্রভাবশালী এক বদকারকে শশ্মানে পাঠিয়ে দিয়েছে। মানবিক দিক দিয়ে এটা অবশ্যই পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত ঘটনা। আমার ক্ষমতা থাকলে আমি দুর্গাকে ছেড়ে দিতাম। কিন্তু আইনের দাবী বড় নির্মম।
আমার দায়িত্বও পালন করতে হবে এবং আইনকেও সাহায্য করতে হবে। আমি দুর্গার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারা মোতাবেক শাস্তির মামলা দায়ের করলাম। আর দুর্গাকে বললাম, তুমি বিষ দেয়ার ঘটনা স্বীকার করবে না। আদালতে দাঁড়িয়ে বলবে, দুলারীকে সে ওখান থেকে যখন নিয়ে যায় তখন ঠাকুর ওখানে ছিলো না।
আর আমিও এমন সাক্ষ্য পেশ করলাম না যে, ঘটনার রাতে ঠাকুর তার বাগান বাড়িতে ছিলো, আর দুর্গাও যে সেখানে গিয়েছিলো এমন সাক্ষ্য পেশ করলাম না।
দুর্গার উকিলও ছিলো খুব জাদরেল লোক। আদালত দুর্গার বিরুদ্ধে কিছুই প্রমাণ করতে পারলো না। তারপর দুর্গা বেকসুর খালাস পেয়ে গেলো।
এর দুদিন পর দুর্গা, তার বোন, স্ত্রী ও তার মা এবং দুলারী, তার ভাই ও বাপ আমার কাছে এসে আর্জি জানালো, মুসলমানদের মধ্যে যে মানবিক বদান্যতা এভাবে চর্চিত হয়, সৎ কাজের এত কদর করা হয় তা তাদের জানা ছিলো না। তাই তারা মুসলমান হতে চায়।
থানা মসজিদের ইমাম সাহেবের মাধ্যমে তাদেরকে কালেমা তায়্যিবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্–পড়িয়ে ইসলামে দীক্ষিত করা হলো।
অবশ্য পরে ইংরেজ ডিএসপি ওদের মুসলমান হওয়ার ঘটনাও শুনেছিলেন। তিনি এ ঘটনায় খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না। মাস তিনেক পর থানা পরিদর্শনে এসে আমাকে বললেন,
তোমরা শুধু আসামী ধরে ধরে শাস্তিই দাও না, হিন্দু ধরে ধরে মুসলমানও বানাও।
এক ইংরেজের মুখে এমন ব্যত্মাক বিদ্বেষমূলক মন্তব্য আমার কাছে ভালো লাগলো না। আমার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে চাকরির মায়া চলে গেলো। আমি দৃঢ় গলায় জবাব দিলাম,
স্যার! ওদেরকে যদি মুসলমান না বানিয়ে ইহুদি-খ্রিষ্টান বানাতাম তাহলে নিশ্চয় আমি আপনার চোখে পুরস্কারের যোগ্য হতাম! কিন্তু এখন তিরস্কারের যোগ্য।
ডিএসপি সাহেব ভাবেন নি, আমি মুখের ওপর এমন কথা বলতে পারবো। তিনি থতমত খেয়ে গেলেন। সম্ভবতঃ তার ভুলটি বুঝতে পেরেছিলেন।
তার লাল বর্ণের মুখটি আরো লালচে হয়ে উঠলো।
ব্যাপারটি আমাকে দারুন আনন্দ দিলো।
পীরের কেরামতি যারিনার তেলেসমাতি
পীরের কেরামতি যারিনার তেলেসমাতি
বিয়ের এক মাস পর কারো স্ত্রী লা পাত্তা হয়ে গেলে আমার মতে সেটা যে কারো জন্যই সমুদ্রের অতলান্তে পড়ার মতো ঘটনা। আমি তখন সাব-ইনপেক্টর ছিলাম।
এক লোক একদিন থানায় এসে জানালো, বিয়ের এক মাসের মাথায় তার স্ত্রী লা পাত্তা হয়ে গেছে। তার ভেতরে ক্রোধের আগুন জ্বললেও চেহারা ছিলো লজ্জায় অনুতাপে আনত।
থানার রিপোর্ট করতে তার সঙ্গে আসে তার বাবা ও মেয়ের বাবা। দুদিন হয়েছে এক মাসের বধু কন্যা গুম হয়েছে। অর্থাৎ এক মাস আগের বিয়ে যাদের হয়েছিল সেই বর বাড়ি থেকে গুম হয়েছে। তাদের দাবী, মেয়ে অপহৃত হয়েছে।
জিজ্ঞেস করলাম, কে অপহরণ করেছে? তাদের এটা জানা নেই।
তাহলে কি কাউকে সন্দেহ হয়? না, তাদের কাছে কাউকে সন্দেহজনক মনে হয় না।
ওদের গ্রামটি ছোটও নয়, বড়ও নয়। মাঝারি ধরনের। এরা স্বচ্ছল মুসলিম পরিবার। মেয়েও বাড়িও বেশ অবস্থাসম্পন্ন।