আমি ঠাকুরকে এ থেকে ফেরাতে অনেক চেষ্টা করলাম। তাকে এও বললাম, আমার বিশ্বাস হয় না, কোন মানুষের এমন অদৃশ্য শক্তি থাকতে পারে। কিন্তু ঠাকুর কোন কথাই শুনতে তৈরী ছিলেন না।
তিনি আমাকে বললেন, যা খুশি তুমি চাও তোমাকে আমি দেবো, আগে মেয়েকে উঠিয়ে আনন। পরে যা করার করবো আমি। এরপর শুধু বাকি থাকবে লাশ গায়েব করার কাজ।
***
এরপর দুর্গা সে কথাই শোনালো যা দুলারী বলেছিলো। দুর্গার নেতৃত্বেই দুলারীকে অপহরণ করা হয়েছিল।
ঘটনার রাতে আমি ঠাকুরের বাগান বাড়ির কামরায় গিয়ে দেখলাম, ঠাকুর সেখানে রয়েছেন- দুর্গা তার বয়ানে বললো- তার সামনে ছিলো শরাবের দুটি গ্লাস। পাশে শরাবের বোতল পড়েছিলো। আমি যে কামরার দরজায় এসেছি ঠাকুর সেটা টের পাননি। দেখলাম, তিনি ছোট একটা পুরিয়া খুলে শরাবের একটা গ্লাসে ঢেলে দিলেন। তারপর গ্লাসটা হাতে নিয়ে হালকাভাবে ঝাঁকি দিলেন। সেটা ছিলো সামান্য পাউডার…….
আমাকে মুহূর্তের জন্যও ভাবতে হলো না। আমার মনে ডেকে উঠলো, ঠাকুর একটি গ্লাসে শরাবের সঙ্গে বিশ মিশিয়েছেন। আর এটা পান করাবে দুলারীকে। আমার মনে পড়ে গেলো, আজকে সোমবার। এই বিশ খাওয়ার পর দুলারী নিশ্চয় আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত মরে যাবে…..
আচমকা ঠাকুর আমার দিকে ফিরে তাকালেন। বললেন, ভালো করেছো তুমি এসেছে। আমাদের সঙ্গে তুমিও খেয়ে পিয়ে নাও। ঠাকুর গ্লাস দুটি হাতে নিয়ে অন্য কামরার দিকে রওয়ানা দিলেন।
আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম- ঠাকুর জি! খুব খারাপ দেখাচ্ছে, আপনি সাধারণ একটি মেয়ের সামনে নিজ হাতে গ্লাস নিয়ে গিয়ে রাখবেন। আমি আপনার নওকর। এ তো আমার কাজ। গ্লাস ও খাবার দাবার আপনার ও দুলারীর সামনে নিয়ে রাখবো।
যে গ্লাসে পাউডার মেশানো হয়েছে ঠাকুর তার ওপর হাত রেখে বললেন, এ গ্লাসটি দেবে দুলারীকে…..
ঠাকুর তো মহা খুশি আমি তাকে মহারাজা বানিয়ে দিয়েছি। কিন্তু হুজুর! জানি না আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন কিনাঃ আমার ভেতর তখন অন্যরকম এক পরিবর্তন এসে গেলো।
আমি তো জানতামই, এই মেয়েকে ঠাকুরের হাতে মরতে হবে। কিন্তু যখন মদের মধ্যে পাউডার মেশাতে দেখলাম তখন বুঝে গেলাম, এটা বিষ। তাছাড়া ঠাকুর বিশেষ করে আমাকে বলেছে, ঐ গ্লাসটি দুলারীর সামনে রাখতে হবে। আমার ওপর ঠাকুরের শতভাগ আস্থা ছিলো। ঠাকুর অন্য কামরায় চলে গেলেন….
আমার ভেতর কী যেন কেপে উঠলো, আহা! বুড়ো এক বাপের একটি মাত্র মেয়ে। বাপও শরীফ লোক। বেটিও শরীফ ……হুজুর। আমি অনেক মন্দ লোক। কিন্তু গাঁয়ের যে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন কখনো কোন মেয়েকে আমি আপত্তিকর চোখে দেখিনি।
আমার বোনের কথা মনে হলো আমার, যে বিধবা হয়ে আমার ঘরে বসে আছে। ওকে যদি এভাবে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং থোকা দিয়ে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে তাহলে আমার বৃদ্ধ মার কি অবস্থা হবে?
আমার এটাও মনে পড়লো, দুলারীকে আমিই উঠিয়ে এনেছিলাম। তার বাপের না জানি কি অবস্থা…..।
ঠাকুর আপনাকেও তো থোকা দিয়েছিলো। দুলারীর বাপকে থানায় নিয়ে এসে মেয়ের অপহরণ মামলা দায়ের করে যায়। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম দুলারীকে বাঁচাতে হবে। আর এই ঠাকুর বাচলে অনেক মানুষের ক্ষতি করবে। গ্লাস পাল্টে দিলাম। ঠাকুরের সামনে রাখলাম বিষের গ্লাস। আর দুলারীর সামনে রাখলাম ঠাকুরের গ্লাসটি।
আমি ঠাকুরের দিকে তাকালাম। ঠাকুরও আমার দিকে তাকালেন। আমি তাকে চোখ টিপে দিলাম। ঠাকুরের ঠোঁটে তখন নিষ্ঠুর হাসি ঝুলছিলো। ঠাকুর তো নিশ্চিত ছিলেন, সকাল পর্যন্ত দুলারী শেষ হয়ে যাবে। তখন তার খুপড়ির হাড় কেটে নেয়া হবে। এরপর বাগানে কোথাও লাশ মাটি চাপা দিয়ে রাখবে।
ঠাকুর জানতেও পারলেন না আমি তার মৃত্যুর ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বড় আয়েশ করে গ্লাসের সবটুকু মদ ঠাকুর সাবাড় করে দিলেন।
শরাবে বিষ মেশানো হলো কেন? দুধ বা অন্য কোন খাবার জিনিসেও তো মেশাতে পারতো?
আসলে শরাব যেহেতু একটু তিতকুটে হয় তাই এতে বিষের স্বাদ জিহ্বায় অনুভূত হয় না। আর এটা ঠাকুরেরই আবিষ্কার ছিলো যে, শরাবে বিষ মেশানো হবে।
আমি অনুমান করছিলাম, ঠাকুর সকালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এই অনুমান করার কারণ হলো, ঠাকুর দুলারীকে মঙ্গলবার সকালে মৃত অবস্থায় দেখতে চাচ্ছিলেন। ঠাকুর যখন বিষের ক্রিয়া সহ্য করতে না পেরে তার বাড়ির দিকে রওনা করেছিলেন আমি তখন দুলারীকে নিয়ে সেখান থেকে পালালাম। এক গ্রামে আমার এক বন্ধু ছিলো। যে পেশাদার ছিনতাইকারী। সেটা অন্য থানায়। রাতের মধ্যেই দুলারীকে ওখারে নিয়ে গেলাম…….
আমি ওকে ওর বাবার কাছে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু সেখানে আপনার হুলিয়া আমার ওপর ঝুলছিলো। তা ছাড়া ঠাকুর যদি মরে গিয়ে না থাকে তাহলে তো…
আসলে আমি এমন কাজ করতে পারবো কখনো তা ভাবতে পারিনি। তাই কোন কিছু ঠিক করতে পারছিলাম না। দিশেহারার মতো হয়ে গিয়েছিলাম। তাই আমি ওকে আমার ছিনতাইকারী বন্ধুর ওখানে নিয়ে গেলাম।
এটি সেই ছিনতাইকারী যে একবার আমার এলাকায় ধরা পড়েছিল? তারপর তুমি ওর ছাফাই গেয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলে- আমি জিজ্ঞেস করলাম।
জি হুজুর! সেই- সে বললো আমাকে, আগের ইনস্পেক্টরের সঙ্গে তার চুক্তি ছিলো। তখন সে নিরাপদও ছিলো। কিন্তু নয়া ইনস্পেক্টর এসেই তাকে হুমকি দিয়েছে যে, এই এলাকা থেকে বেরিয়ে যাও না হয় জানে মেরে ফেলবো। এজন্য সে নিজেই সেখান থেকে গাঠুরী গোল করছিলো। আমাকে সরাসরি বললো, ভাই! এই মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে এখনই পালাও, না হয় তোমরা ধরা পড়ে যাবে……….