আমি কাঁদতে শুরু করলাম। মিনতি করে বলতে লাগলাম। আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও। ভেবেছিলাম, ওরা আমাকে নিয়ে জোর জবস্তি করবে। কিন্তু তারা তা করলো না। ঠাকুর আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, আমাকে তিনি খারাপ উদ্দেশ্যে উঠিয়ে আনেন নি।
তিনি ভগবানের কসম খেয়ে বললেন, তিনি আমাকে বিয়ে করবেন। দুর্গাও আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করলো।
আমি ওদেরকে বললাম, বিয়ে কি
মানুষ এভাবে করে? ….. আমার বাপকে বললো, তিনি গরিব মানু। বললেই তিনি বিয়েতে রাজি হয়ে যাবেন……।
ঠাকুর বললেন, তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমার বাবা তখন চিঠির মাধ্যমে আমার ভাইয়ের মতামত চান। ভাই নিষেধ করে দেন।
ঠাকুর আমাকে একথাও বলেন, তুমি আমার মনে এমনভাবে ঢুকে পড়েছে যে, তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।
দুর্গা খারাপ লোক ঠিক, কিন্তু সেও আমাকে বললেন, দেখো দুলারী! সত্য কথা হলো, তোমাকে না পেয়ে নিশ্চয় তোমার বাপ পেরেশান হবে। আমি তাকে বলবো, তোমার মেয়েকে আমি খুঁজে বের করে দেবো।
কামরায় দুটি দরজা ছিলো। দরজা দুটি তালা লাগিয়ে ওরা চলে গেলো। সারা রাত ভয়ে ভয়ে কাটালাম আমি। ওরা আমাকে সামান্যতম বিরক্তও করেনি। পরের দুদিন ঠাকুর আমাকে বুঝিয়ে গেলো, আমি যেন দু একটা দিন ধৈর্য ধরি তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি বুঝতে পারলাম, আমার ইজ্জত নিয়ে ঠাকুরের মতলব খারাপ নয়। হলে তো ঠাকুর যেকোন সময় তার মনোবাসনা পুরন করতে পারতো…….
ঠাকুর অনেকগুলো টাকা ও সোনার অলংকার আমার সামনে রেখে মিনতি করে বলতে লাগলেন,
আমি তোমাকে রাণী বানিয়ে দেবো। তার এই বিনয় ভাব ও টাকা পয়সা দেখে ঠাকুরের প্রতি করুণায় ভরে উঠলো আমার মন। আমি তাকে বললাম, এগুলো আপনার কাছে রেখে দিন। আগে আমার বাপকে রাজি করান।
আচ্ছা দুলারী! দূর্গা কি সব সময় ঐ কামরায় থাকতো?
না সে মাঝে মধ্যে আসতো।
দুর্গা তোমাকে ভয় দেখাতো না?
না জনাব! দুর্গা তো খুব সুন্দর করে কথা বলতা। তৃতীয় রাতে ঠাকুর আমার জন্য বিরাট খাবারের আয়োজন করলেন। বললেন, আজ তোমাকে দারু (মদ) পান করাবো।
আমি বললাম, ছিঃ ছিঃ এগুলো তো খারাপ জিনিস। আমি পান করবো না। ঠাকুর বড় করুণ গলায় বললেন, আমি এত করে বলছি, দুএক ঢোক পান করে দেখো না। তার মন গলানো ব্যবহার দেখে আমি রাজি হয়ে গেলাম। তিনি অন্য কামরায় চলে গেলেন। হয়তো শরাবের বোতাল ওখানে ছিলো…..
***
এ সময় দুর্গার আওয়াজ শুনতে পেলাম। সে ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলছিলো। পরক্ষণেই ঠাকুর খালি হাতে এ কামরায় এসে আমার সামনে বসে পড়লো। তার পর দুর্গা এলো। তার হাতে শিরকার দুটি গ্লাস ছিলো। একটি গ্লাস আমার হাতে দিলো। আরেকটি ঠাকুরের হাতে।
খাও খাও- ঠাকুর বললেন। আমি ভয়ে ভয়ে একটু মুখে নিলাম। তিতায় আমার মুখ বিকৃত হয়ে গেলো। ঠাকুর তখন আমার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে নিলেন। ঠাকুর আর দুর্গা এক নিঃশ্বাসে গ্লাস শেষ করে ফেললো। তাদের বার বার বলায় আমি একটু একটু করে আমার গ্লাসও খালি করে ফেললাম। ঠাকুর ভাজা মুরগির একটা বড় টুকরার প্লেট সামনে রাখলেন …..
ঠাকুর তখন বললেন, আমার মাথাটা ঘুরছে।
দুর্গা বললো, তাহলে আরেকটু পিয়ে নিন। দুর্গা আরো অর্ধেক গ্লাস এনে ঠাকুরের হাতে দিলো। ঠাকুর সেটা মুখে দিয়েই কখনো তার পেটে কখনো মাথায় হাত ফেরাতে লাগলেন। চোখমুখ কুচকে বললেন
দুর্গা! তুমি ভুল করোনি তো?- দুর্গা হেসে বললো, সে কি ঠাকুর সাব!
দুর্গা এ কথা বলে কি বোঝাতে চাইলো বুঝলাম না আমি…….
ঠাকুরের অবস্থা খারাপের দিকেই যাচ্ছিলো। দুর্গাকে বললেন, তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে। দুর্গা বললো, তিনি যেন আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়িতে চলে যায়। সে গেলে দুলারী এখানে একলা রয়ে যাবে। ঠাকুর বিড় বিড় করে কি যেন বলতে বলতে চলে গেলেন। একটু পর দুর্গা আমাকে বললো, দুলারী! চলো এখান থেকে পালাতে হবে।
কোথায় নিয়ে যাবে?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।
শোন। এখানে থাকলে তুমি মারা যাবে- দুর্গা বললো- তুমি কুমারী মেয়ে। ঠাকুর তোমাকে এক সন্যাসীর কথায় অপহরণ করেছে। দুএকদিনের মধ্যে তোমাকে কতল করে তোমাকে দিয়ে জাদু টোনা করবে। তখন ঠাকুর বিরাট ধন ভাণ্ডারের মালিক বনে যাবে।
আমার সন্দেহ হলো- দুলারী বলে গেলো- দুর্গা মনে হয় আমাকে ধোকা দিচ্ছে। কিন্তু সে যখন পুরো কথা বুঝিয়ে বললো আমি শুধু বিশ্বাসই করলাম না, ভয়ে কুকড়ে গেলাম। দূর্গা তো এখানেই আছে ওকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। ওর সঙ্গে আমি ঠাকুরের বাগান বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলাম। রাতভর আমরা পায়দল চললাম।
সকালের দিকে দুর্গা আমাকে এক গ্রামে নিয়ে গেলো। সেখানে তার পরিচিত এক বাড়ির পৃথক কামরায় নিয়ে আমাকে বসালো। এক বুড়ি আমাকে এক বাটি দুধ ও দুটি পরোটা খাওয়ালো।
অনেক্ষণ পর দুর্গা এলো। আমাকে বললো, তোমাকে আমি তোমার ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাবো। আমার কাছ থেকে জেনে নিলো আমার ভাই থাকে জবলপুর জাট রেজিমেন্টে…….
এবার দুর্গার ওপর আমি সন্ধিহান হয়ে উঠলাম। তকে বললাম, তুমি আমার বাপের কাছে না নিয়ে ভাইয়ের কাছে কেন নিয়ে যাবে?
সে বললো, আমরা তোমার গ্রামে গেলে ঠাকুরের লোকেরা আমাদের আস্ত রাখবে না। তাছাড়া পুলিশ তার হাতে আছে। আমাদেরকে সোজা জেলখানায় চালান করে দেয়া হবে। তাই তোমার ভাইয়ের কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা তাকে শোনালে সে সবকিছু বুঝতে পারবে।