অবশ্যই দেবো।
তুমি আমাকে ভালোবাসো?
তোমার কোন সন্দেহ আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তোমাকে। বলতে বলতে ডোনান্ড আমার সামনে হাটু মুড়ে বসলো।
তাহলে আমি যা চাইবো তা আমাকে দেবে?
যা চাইবে সব দেবো। কি চাও তুমি?
শামসের জীবনের নিরাপত্তা। যে পর্যন্ত তুমি ওর দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত না হবে, তুমি ওকে বাগে পেলেও মারাবে না এবং গ্রেফতারও করবে না।
ডোনান্ডের চোখে মুখে একজন পরাজিত মানুষের বিষণ্ণ ছায়া নেমে এলো। অনেকক্ষণ কিছুই বললো না। কংক্রিটের ছাদের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
এর বিনিময়ে কি তুমি আমাকে ভালোবাসবে? অনেক্ষণ পর ডোনান্ড ভাঙ্গা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
হ্যাঁ, ভালো না বাসলেও ঘৃণা করতে চেষ্টা করবো না। আর শোন, ভালোবাসার কোন বিনিময় হয় না।
ঠিক আছে আমি চেষ্টা করবো? ডোনাল্ড কাষ্ঠ হেসে বললো।
এরপর আর ডোনাল্ড বেশিক্ষণ রইলো না। চলে গেলো। ডিউটিতে ব্যস্ত থাকায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্লা দিন দিন ভারী হওয়ায় ডোনাল্ড একাধারে কয়েক দিন বাসায় ফিরলো না।
৬ষ্ঠ দিনের দিন রাতে নয়টার দিকে খবর এলো, ডোনাল্ড আলজাযায়েরের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সম্মুখ লড়াইয়ে নিহত হয়েছে। শুনে খুব খারাপ লাগলো। লোকটা আমাকে খুব ভালোবেসেছিলো। বিনিময়ে ওকে আমি ঘৃণা ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি। কেন জানি খুব কান্না এলো। কাঁদলাম অনেক্ষণ।
পরদিন শামসের বাসায় গিয়েও খালাম্মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না কান্না করলাম। তারপর খালাম্মা আম্মাকে সান্ত্বনা দিয়ে সেই প্রস্তাবটি দিলেন। মুসলমান হওয়ার এবং শামসের…আর বলতে পারছি না। মনে পড়লে এখনো আমার দুচোখ ভরে অশ্রু নেমে আসে।
শামসের আম্মু আমাকে মুসলমান হওয়ার দীক্ষা দিলেন। আমার চমৎকার একটি নামটি রাখলেন। তাসমিয়া। আমিএখন মারকোনী নই, তাসমিয়া।
আর দ্বিতীয় প্রস্তাবটির জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না তখন। যদিও কাংখিত ছিলো। শামসও প্রস্তুত ছিলো না। শামস্ বললো,
আম্মু! মারকোনী মানে তাসমিয়া এখন ওদের বাসাতেই থাকুক।
হ্যাঁ, তাসমিয়া! শামস আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমিএখন আমাদের ক্যাম্পে চলে যাচ্ছি। আশা করি তুমি বর্তমান অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করবে। মাঝে মধ্যে আম্মুকে এসে দেখে যেয়ো। যেদিন আলজাবায়ের স্বাধীণ করতে পারবো সেদিন তোমাকে তোমাদের ঘর থেকে তুলে আনবো। আল বিদা… আল বিদা তাসমিয়া
এগার মাস পর। আলজাযায়ের স্বাধীন হলো। আলজাযায়েরের মুসলিম মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মাতৃভূমিকে দখলদার ফ্রান্সীদের কবল থেকে উদ্ধার করলো। মুক্তিযযাদ্ধারা দারুণ খুশি। টিভিতে খণ্ড খণ্ড বিজয়-উত্সব এবং ছোট ছোট মিছিলের দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। যুদ্ধের বিভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে। সেকি লোমহর্ষক দৃশ্য। দেখানো হচ্ছে লড়াকু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, আহতদের এবং শহীদদের ছবিও।
মুক্তিযোদ্ধারা যার যার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে। ফিরে যাচ্ছে আপনজনদের কোলে। কিন্তু শাস ফিরে এলো না। ফিরে আসছে না। এক দিন দুই দিন সাত দিন। শাম্স আসছে না। কিছু বলতে পারছে না। শাম্সের আম্মু আর আমি মুক্তিযুদ্ধে ক্যাম্পগুলো চষে ফেললাম। হাসপাতাল, ক্লিনিক, কোনটাই বাদ গেলো না। কেউ বললো, শামস্ বেঁচে আছে, কেউ বললো, শামস অসাধারণ যুদ্ধ করেছে। দারুণ করিশমা দেখিয়েছে; কিন্তু সামান্য আহত হয়েছে।
সপ্তম দিনে শামসের মার চোখে পানি দেখলাম। এই প্রথম কাঁদতে দেখলাম তাকে। সেকি কান্না! বুক উজাড় করা কান্না। বুক খালি করে কাঁদলাম আমিও।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার দশ দিন পর ঘোষণা এলো, আজ টিভিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পুরস্কৃত করার অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।
রাত নয়টায় অনুষ্ঠান শুরু হলো। একে একে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ অবদানের জন্য পদক দেয়া হলো। সব শেষে উপস্থাপক ঘোষণা দিলো,এখন বারজন। বীরশ্রেষ্ঠকে স্বর্ণপদক দেয়া হবে। তিন নম্বরে ঘোষণা হলো শামসের নাম।
শামসের আম্মা আর আমি দুজনই চমকে উঠলাম। দুজনের দৃষ্টিতে দিশেহারা ভাব ফুটে উঠলো। অধীর প্রতীক্ষার জ্বালা দুজনকেই যেন আগুন অঙ্গার করে দিচ্ছিলো। অবশেষে মঞ্চ এলো। দৃঢ়-ঋজুভঙ্গিতে এক দীপ্তিমান পুরুষ। শাম্স। আমাদের শামসা পদকটি হাতে নিয়ে শুধু বললো,
আমার এই পদক উৎসর্গ করলাম আমার মাকে, আমার প্রিয় মারকোনিকে এবং হাজার হাজার মুক্তিকামী শহীদদেরকে।
মা ঝাপসা চোখে আমার দিকে তাকালেন। স্মিত হেসে বললেন,
তাসমিয়া! তুমি কি এখনো মারকোনি?
না; খালাম্মা। আমি মারকোনী নই, আমি তাসমিয়া আমি হেসে বললাম।
তাহলে ও এসে যে পর্যন্ত তোমাকে তাসমিয়া বলে না ডাকবে তুমি ওর কথার কোন জবাব দিবে না; মা সকৌতুকে বললেন এবং পরম স্নেহে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
ঈমানের ঝলক
ঈমানের ঝলক
১৮২৬ এর পহেলা ডিসেম্বর। সূর্যাস্ত হয়নি এখনো। তবে মোগল সালতানাতের অমিত তেজী সূর্য সেই কবে থেকে অস্তাচলের পথে যাত্রা শুরু। করেছে। সালতানাতের রক্ষাকবচ হিসেবে যে কেল্লাগুলো মোগলীয় হস্তে নির্মিত হয়েছিলো সেগুলো এখন তাদের কবরগুলোর মতো উদাস-নীরব দর্শক হয়ে আছে। এর মধ্যে একটি কেল্লা হলো কেল্লায়ে লাহোর। যাকে বলা হয় শাহী কেল্লা। এই কেল্লা এখন শিখদের কজায় রয়েছে।