শামসের নামটা শুনতেই আমার ভেতরটা শিহরিত হয়ে উঠলো। আমার মুখটাও হয়তো লাল হয়ে উঠেছিলো। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম স্বাভাবিক থাকতে। সেটা লিলিয়ানের চোখ এড়ালো না।
নামটা শুনেই অমন লজ্জা রাঙা হয়ে উঠলে? বলতে গিয়ে লিলিয়ানের চোখে মুখে কৌতুক ফুটে উঠলো।
না, না, ওরকম কিছুই না। কি বলছো এসব লিলিয়ান? আমরা এক সঙ্গে লেখাপড়া করি। পাশাপাশি পড়ি। এই তো এর চেয়ে বেশি কিছু না। বলতে সিয়ে আমার গলা কেঁপে উঠলো।
ওরকম কিছু তো আমি বলিনি মারকোনি! আমি শুধু বলেছি এমন লজ্জা রাঙা হয়ে উঠলে কেন? ওতেই তুমি এতগুলো কথা বলে ফেললে। যে কেউ শুনলেই বুঝতত ওই ছেলেকে তুমি প্রচণ্ডরকম ভালোবাসে। কিন্তু তুমি কি ফুসলমান ছেলে ছাড়া আর কোন ছেলে পেলে না? তোমাদের ইতালিয়ানদের মধ্যেই তো কত দারুণ দারুণ ছেলে আছে। তাছাড়া মুসলমানরা তো অন্য ধর্মের লোকদেরকে বিধর্মী বলে। অন্য ধর্মের সবাই ওদের শত্রু। যুদ্ধ, লড়াই, দাঙ্গা, ফাসাদ করতেই ওরা ভালোবাসে…।
চুপ করো লিলিয়ান! আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম অনেকটা উত্তেজিত কণ্ঠে, অনেক বলে ফেলেছে। মানুষ যেটা জানে না সেটাকেই শত্রু বা বৈরী মনে করে। মুসলমানদের ব্যাপারে জানো না বলেই এ ধরনের মন্তব্য করতে পারছে। মুসলমানরা অন্য ধর্মের লোকদেরকে কখনোই শক্র মনে করে না। বরং আমরাই ওদেরকে অকারণে শত্রু মনে করি। বছরের পর বছর ধরে মুসলমানদের সঙ্গে আমরা বাস করে আসছি। কখনো কি ওদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। শামস আমাকে বলেছে, ইসলামই একমাত্র ধর্ম যেখানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিলে মিশে থাকার এক চমৎকার আদর্শ শিক্ষা দেয় তার অনুসারীদের …।
এখন ফ্রান্সীরা অন্যায়ভাবে ওদেরকে ওদের মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে চাচ্ছে বলেই তো ওরা রুখে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া তো ওদের কিছু করারও ছিলো না। এজন্য কি ওদেরকে যুদ্ধবাজ-দাঙ্গাবাজ বলাটা উচিত হবে
তুমি শামসের কথা বলেছে। হ্যাঁ, আমাদের ইতালিয়ান ক্যাথলিকদের মধ্যে অনেক সুদর্শন যুবক আছে। কিন্তু ওদের মধ্যে আর শামসের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। সেই শৈশব থেকে শামস আমার খেলার সঙ্গী। এক সঙ্গে আমরা একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ালেখা করি। এমনকি একই গাড়িতে করে আমরা দিনের পর দিন স্কুলে আসা যাওয়া করেছি। এভাবেই আমরা বড় হয়েছি। সবকিছু বুঝার মতো বয়সে পৌঁছেছি।…
কিন্তু আমি যে ওকে পছন্দ করি এ কথা কখনো ওকে আমি বলিনি এবং সেও আমাকে মুখ ফুটে কখনো কিছু বলেনি। বুও আমাদের মধ্যে যে একটা অব্যক্ত ভালো লাগার সম্পর্ক আছে সেটা আমরা বেশ অনুভব করতে পারি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কি জানো? ও আমাকে কখনো ইচ্ছে করে স্পর্শ করেনি। একটু ছুঁয়েও দেখেনি। অথচ তুমি যাদের কথা বলছে ওসব ছেলের সঙ্গে দুঘণ্টার পরিচয়েই তো শুধু সম্পর্ক নয়, অনেক কিছুই ঘটে যায়। খুব সহজেই ওরা মেয়েদের কুমারিত্ব হরণ করে নিতে পারে। এসব ছেলের সঙ্গে শামসের তুলনা?
সরি! মারকোনী! আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি। তুমি যা বলেছে তাই হয়তো ঠিক। আমি একদিন তোমার শামসকে কলেজের ক্যাম্পাসে একা পেয়ে ডেটিংয়ের অফার করেছিলাম। ও আমাকে এমন হেলা ফেলা করে প্রত্যাখ্যান করলো যে, আমি খুবই ইনসান্ডেট ফিল করলাম। অথচ এই প্রথম কোন ছেলে আমাকে প্রত্যাখ্যান করলো। সম্ভবতঃ সেই ক্ষোভেই তোমাকে ও ভাবে কথাগুলো বলেছি।
***
এ কথা শামস আমাকে বলেনি। এজন্য আমার তেমন খারাপও লাগলো না। কারণ, শামস এসব মেয়ে ঘটিত ব্যাপারগুলো যেমন অপছন্দ করে এসব নিয়ে আলোচনা করতেও অপছন্দ করে। অবশ্য লিলিয়ানের সঙ্গে আমার যে কথা হয়েছে সে ব্যাপারেও আমিও যে কিছু বলিনি! বলার চেষ্টা করলেই নিজে নিজে লজ্জায় লাল হয়ে যেতাম। অবশ্য তেমন সময় সুযোগও আসেনি। এর সপ্তাহ খানেক পরই ওদের বাড়ি ফ্রান্সী পুলিশ রেড করে।
এরপরের ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটে গেলো, আমি দিশেহারার মতো হয়ে গেলাম। আমার ওপর সার্জেন্ট ডোনাল্ডের চোখ পড়া, বিয়ের প্রস্তাব এবং বিয়ে করা কোন কিছুই যে শামসের চোখ এড়ায়নি এটা আমি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছিলাম। একারণে শামসের মনোকষ্ট আমাকে ক্ষত বিক্ষত করেছিলো। সত্যিই, শাস্স ও তার মা এবং আমার বাবার জীবন বাঁচানোর জন্য এ ছাড়া কোন বিকল্প পথ ছিলো না।
ডোনান্ডকে আমি নরপশুর চেয়ে বেশি ঘৃণা করতাম। কিন্তু ও আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। এ কারণেই হয়তো ওর প্রতি আমার ঘৃণার তীব্রতা কিছু কমে এসেছিলো।
এর মধ্যে একদিন খবর এলো, শামস ফ্রালীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। খবরটা দিলো ডোনাল্ড। শুনে মনে হচ্ছিলো, আমার স্বপ্নের অবশিষ্ট দুনিয়াটাও যেন ভেঙ্গে পড়েছে। আমি ডোনান্ডকে চেপে ধরলাম, তোমার দ্বারা যেন ওর কোন ক্ষতি না হয়।
মারকোনী! লক্ষ্মী! পাগলামি করো না। সে তো এখন আর তোমার কেউ নয়। ওকে নিয়ে তোমার এত দুশ্চিন্তা কেন যেকোন সময় ও ফ্রান্সীদের হাতে মারা পড়বে। এক সময় ওর কথাও তুমি ভুলে যাবে।
বিশ্বাস করো ডোনাল্ড! আমি হয়তো তোমাকে ভুলে যাবে। কিন্তু ওকে কখনো ভুলবো না। আমি ক্ষেপাটে গলায় বললাম।
শান্ত হও মারকোনী! এসব তুমি কি বলছো?
আমার একটা কথার জবাব দেবে?