চক পাথার পাহড় থেকে একটু সরে আট হাজার ফিট উঁচু আরেকটি পাহাড় কর্নেল কিয়ানীর ছোট একটি সেনাদল মোর্চাবদ্ধ হয়ে আছেন। এ কোম্পানীর কমান্ডার ফটোহার এলাকার মেজর জামশেদ গুলজার। যিনি এক্স সোর্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট লেফটেনেন্ট কর্নেল (অব) মুহাম্মদ গুলজার খানের ছেলে। এ কোম্পানীর এক অংশ আগেই অন্য পাহাড়ে গিয়ে পজিশন নিয়েছে। কর্নেল কিয়ানী মেজর জামশেদ গুলজারকে ওয়ারলেসে নির্দেশ দিলেন, তোমার পোষ্ট থেকে নিচে নেমে আসে এবং পাহাড়ের অন্যদিক থেকে চক পাথার এর ওপর হামলা করো।
মেজর জামশেদ গুলজারকে তার জোয়ানদের নিয়ে আট হাজার ফিট উচ্চতা থেকে নেমে তারপর সারে নয় হাজার ফিট পাহাড়ে চড়ে এবং কোন ধরনের বিশ্রাম না নিয়ে হামলা করতে হবে। পাহাড় থেকে অবতরণ পাহাড় আরোহণের চেয়ে কষ্টদায়ক ও কঠিন কাজ। তবুও মেজর জামশেদ খুব দ্রুত পাহাড় থেকে নেমে শত্রু কবলিত পাহাড়ে আরো দ্রুত জোয়ানদেরকে নিয়ে উঠলেন।
মেজর জামশেদ বলেন, আমার ওয়ারলেসে কর্নেল কিয়ানীর দরাজ কণ্ঠ একটু পর পর শোনা যাচ্ছিলো। একবার তিনি বললেন, বেটা মেজর জামশেদ! পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটি জপতে জপতে এগিয়ে যাও। ফিল্ড মাইন ও দুশমনের মেশিনগানের গোলা তোমাদের পথ দেখাবে।
আয়াতটি তিনি পাঠ করতে লাগলেন। যার অর্থ হলো, যারা ঈমানদার ও সকর্মী তাদেরকে পৃথিবীর কর্তৃত্ব দানের ওয়াদা দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা।
ফায়ারিং ও গোলাগুলির এমন প্রচন্ডতা ছিলো যে, ধোয়ায় চারদিক ঝাপসা হয়ে আসছিলো। পাহাড়ি গাছগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছিলো। পুরোটা পরিবেশ আগুনের গোলায় পরিণত হলো। নমরূদের এই অগ্নিকুন্ডের মধ্য দিয়ে মেজর জামশেদ ও তার জোয়ানরা অক্ষত- নিরাপদে বেরিয়ে গেলো। কর্নেল কিয়ানী যখন তার পজিশনে দাঁড়িয়ে লড়াই কন্ট্রো করছিলেন তখন থেকে থেকে বিড় বিড় করে তার ঠোঁট দুটি নড়ে উঠছিলো।
মেজর জামশেদ গুলজার সে সময়ের প্রতিক্রিয়া ও অনুভূতি একটি চিঠির মাধ্যমে তার বাবা লেফটেনেন্টে কর্নেল মুহম্মদ গুলজারকে যুদ্ধ শেষে জানান। চিঠিতে লড়াইয়ের অনেকখানি উঠে আসে। চিঠিটি ছিলো এরকম,
শ্রদ্ধাস্পদ আব্বাজান
আসোলামু আলাইকুম।
আপনি লিপা উপত্যকায় অপারেশন সম্পর্কে অনেক কথাই শুনে থাকবেন। কিন্তু সেখানে যা ঘটেছিলো তা এরকম :
১৯৭২ এর শেষের দিকে ভারতীয়রা বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে আচমকাই লিপা উপত্যকার অনেকখানি অংশ দখল করে নেয়। তারপর থেকে তাদের অতি আক্রমণাত্মক আচরণ আমরা সয়ে যেতে লাগলাম। উপত্যকার সব উঁচু অংশগুলো তাদের দখলে চলে গেলো। প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের চরম সংকটের মধ্যে থাকতে হতো। যেকোন সময় ওরা আমাদেরকে মুজাফফর আবাদের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারতো।
যুদ্ধ বন্ধের সামরিক চুক্তির কারণে ওরা হামলা মুলতবী রাখলেও মৌখিকভাবে কয়েকবারই এ হুমকি দিয়েছে, আমরা যেন উপত্যকা খালি করে চলে যাই। ওদের অবস্থান এমন উচ্চতা ও অনুকূল ছিলো যে, আমাদের প্রতিকূল অবস্থানে থেকে মনে হতো, আমরা ওদের পায়ের নিচে বসে আছি। ওদের পা চাটছি আমরা। তারপরও আমরা এমন এক ট্রাজেডির সম্মুখীন ছিলেম যে, দুশমন আমাদেরকে মাটির পুতুলের অধিক কিছু মনে করতো না। সেটা হলো, যুদ্ধ বন্ধ চুক্তির পর আযাদ কাশ্মীরের একটি ব্যাটালিয়ান চারদিক থেকে দুশমনের ঘেরাওয়ের মধ্যে রয়ে গেলো। তাদের ওখানে রসদ সরবরাহের জন্য ছিলো অতি সংকীর্ণ একটি রাস্তা। এই রাস্তাও দুশমনের করুণার ওপর আমরা ব্যবহার করতাম।…
দুশমনের লোলুপ দৃষ্টি উপত্যকার অবশিষ্ট অংশের ওপর এমনভাবে গেঁথে রইলো যে, আমরা যেন এর কাটা সব সময় অনুভব করতাম। দুশমনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও প্রতিশোধের আগুন যেন দিন দিন আমাদের জোয়ানদের মধ্যে দ্বিগুণ থেকে দিগুণতর হতে লাগলো। ১ মে ১৯৭২ দুশমন তাদের পরিবেষ্টিত আযাদ কাশ্মীরের রসদ সরবরাহের পথটি বন্ধ করে দিলো। ওদের ধারণা ছিলো কোম্পানী ইমোনেশন ও রসদের অভাবে ঘাবড়ে গিয়ে হয় আত্মসমর্পণ করবে না হয় পোষ্ট খালি করে দিবে।…
কিন্তু দুশমন যখন দেখলো, আযাদ কাশ্মীরের জোয়ানরা একেবারেই নির্বিকার তখন তারা ভীষণ ক্ষেপে উঠলো। ৩/৪ মে রাত লিপা উপত্যকায় কেয়ামতের বিভীষিকা নামিয়ে দিলো ওরা। মটরগান ও দূরপাল্লার কামানগুলো অবিরাম গর্জাতে লাগলো। আমাদের সৈন্যসংখ্যা ও ফায়ার পাওয়ার এতই দুর্বল ছিলো যে, দুশমন শতভাগ নিশ্চিত ছিলো সহজেই আমরা লেজ গুটিয়ে পালাবো। পরিস্থিতির বিচারে এটাই ছিলো স্বাভাবিক। কিন্তু সেই অমিত শক্তি সম্পর্কে তাদের কোন উপলব্ধিই ছিলো না, যা আমাদের আত্মার খাঁজে খাঁজে যথাসময়ে ঝলকে উঠে। ওরা ভুলে গিয়ে ছিলো সে খোদায়ী নুসরতকে যা আমাদের প্রতিনিয়তের সঙ্গি।…
পুরো উপত্যকার প্রতিটি ধূলি কণা প্রকম্পিত হচ্ছিলো। কালো ধোয়ায় চারদিক ঢেকে গিয়েছিলো। স্থানীয় দিন মজুর শ্রেণীর লোকেরা পাহাড়ের নিরাপদ গুহায় আশ্রয় নিয়েও ঠক ঠক করে কাঁপছিলো। রাত শেষ হয়ে সকাল দুপুর বিকাল সারা দিনই চললো দুশমনের এই ধ্বংসযজ্ঞ।…
এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরিস্থিতিতে যে কোন কমান্ডার দিশেহারা হয়ে দিগবিদিক ছুটে পালাবে। তাছাড়া এখানে শত্রু পক্ষ কয়েকগুণ বেশি শক্তিশালী এবং তাদের অবস্থানও অনেক সুবিধাজনক স্থানে। এ অবস্থায় জবাবী হামলার কথা কল্পনা করাও হাস্যকর। কিন্তু কর্নেল কিয়ানী ছিলেন আমাদের অধিনায়ক। আমাদের অভিভাবক। যিনি একেবারেই অন্য ধাতুতে গড়া পার্থিব সকল সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে। সাক্ষাত বজ্রের ভয়াবহতা নিয়ে তিনি আমাদের হাল ধরলেন। জবাবী হামলার প্রায় অসম্ভব এক প্লান তৈরী করলেন। …
৫মে রাত সাড়ে তিনটায় কর্নেল কিয়ানী রেডিও ওয়ারলেসে আমাকে নির্দেশ দিলেন, তুমি তোমার মতো করে দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ো। মেজর সাবির শহীদকেও একই নির্দেশ দেয়া হলো। পর মুহূর্তে আমার ওয়ারলেস আবার বেজে উঠলো। কর্নেল কিয়ানীর গলা! তিনি বলছেন, বেটা জামশেদ! তোমার জোয়ানদের বলে দাও দুশমন তোমাদেরকে দেখে অন্ধ হয়ে যাবে। ওদের পুতে রাখা বোমাগুলো তোমাদের এক চুলও ক্ষতি করতে পারবে না।
আমি আমার সিংহপ্রাণ জোয়ানদের হামলার হুকুম দিলাম। জোয়ানরা এ হুকুমের জন্যই আকুল হয়ে অপেক্ষা করছিলো।
দিগন্ত রেখায় ভোরের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়ার আগেই জোয়ানরা চিতার মতো ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লো। প্রতিটি জোয়ান জযবা আর আবেগে পাগল
হয়ে যাচ্ছিলো। আমাদের এ হামলা এতই ক্রোধ উন্মত্ত ছিলো যে, দুশমনের মেশিন গান, মর্টার, কামান ও গ্রেনেড আমাদের পথে যে আগুনের নিরেট দেয়াল দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো, সে দেয়াল আমরা যেন তুরি মেরে উড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে গেলাম। আগুনের সে সমুদ্রে আমার জোয়ানরা কয়েকগুণ আগুনের উত্তপ্ততা নিয়ে দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।…
এক একটি বাংকারে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো আর বিদ্যুৎ গতিতে দশ বারজন করে শিখকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিচ্ছিলো। ওদের মাথার খুলি উড়ে যাচ্ছিলো। বুক ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছিলো। দুশমনের মৃত্যু চিৎকার জোয়ানদের উন্মাদনা- জযবা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।…
ক্রোধে পাগলপারা হয়ে যাচ্ছিলাম আমিও। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই হারানো স্বাধীনতাকামী ভাইদের মুখগুলো; দুশমনরা অন্যায়ভাবে আটকে রেখে যাদেরকে নিপীড়ন করছে। তখনকার নিরস্ত্র নিরপরাধ মুসলমানকে হত্যা করছে। ভেসে উঠছে সেসব শিশুর কচি মুখ; কসাই ভারতীয়দের পৈশাচিক হামলায় মার মুখ খালি করে শহীদ হয়েছে। সেই দুশমন আজ আমাদের খোলা অস্ত্রের মুখে। নর পিশাচ শিখরা অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করছিলো। প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছিলো। যারা ধমক ছাড়া আমাদের সঙ্গে কথা বলতে না। অহংকার ও ঔদ্ধত্যে যাদের ঘাড় সব সময় বেঁকে থাকতো। তারা আজ আমাদের পদতলে; আমাদের করুণার ওপর।….
তাদের জীবন মরণ আমাদের অনুগ্রহের ওপর, আজ ওরা সেদিনকে গালি দিচ্ছে যে দিন ওদের মা ওদেরকে ভূমিষ্ঠ করেছিলো। ওরা আজ ওদের সে সব জেনারেলকে নিকুচি করছে যারা ওদেরকে সাক্ষাৎ যমদূতের কাছে ঠেলে দিয়েছে।
দুপুরের আগেই আমরা চক পাথর পাহাড় দুশমন থেকে ছিনিয়ে নিলাম। তারপর প্রতিরক্ষীয় পজিশন নির্ধারণে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আচমকা দুশমন তাজাম সৈন্য নিয়ে জবাবী হামলা চালালো। এবার যেন ওরা কেয়ামততের বিভিষিকা নিয়ে আমাদেরকে গ্রাস করে ফেলবে। আমরা আরেকবার মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলাম। আমাদের না ছিলো সেনা সাহায্যের আশা, না ছিলো তাজাম সৈন্য। আর না ছিলো ইমোনেশন। আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমরা লড়তে থাকলাম। আমার চোখের সামনে শহীদ হয়ে গেলেন মেজর সাবির খান মাত্র একশ গজ দূরে। আমি মোটেও বিচলিত হলাম না। সঙ্গে সঙ্গে আমি মেজর সাবির খান শহীদের জোয়ানদের নেতৃত্ব আমার হাতে নিয়ে নিলাম। আল্লাহ তাআলা সম্ভবতঃ আমাকে একারণেই জীবিত রেখেছেন দুশমনের তাজাম সৈন্য স্রোতের মতো এগিয়ে আসছিলো। ওরা আসছিলো জয় হিন্দ শ্লোগান তুলতে তুলতে। কিন্তু যখন আমাদের জোয়ানরা রুখে দাঁড়ালো তখন তাদের জয় হিন্দ শ্লোগান মৃত্যুর শেষ আর্তনাদে রূপান্তরিত হতে লাগলো। যেমন স্রোতের মতো ওরা আসছিলো তেমনি একের পর এক ঢলে পড়ছিলো মৃত্যু দূতের কোলে।
দুশমনের এই জবাবী হামলা এমন ভাবে ব্যর্থ হলো যে দুশমন কোন কিছু বুঝেও উঠতে পারলো না। অসংখ্য লাশ আর যখমীদের ফেলে বেঁচে থাকা দুশমন দিক-বিদিক পালাতে লাগলো। যখমীরা পানি পানি করে গোঙ্গাচ্ছিলো। কিন্তু এখন আর পানি ওদের রক্তের শূন্যতা পূরণ করতে পারবে না …।
দুশমনের যেসব কমান্ডাররা হুমকি ধামকি ছাড়া আমাদের কমান্ডারদের সঙ্গে কথা বলতো না তারা এখন অনুনয় বিনয় করতে লাগলো নতুন করে যুদ্ধ বন্ধ চুক্তি করার জন্য…।
৬মে তাদের সে অনুরোধ আমাদের কমান্ডাররা মেনে নেন…।
খোদার অপার সাহায্য যে ছিলো এ বিজয়ের একমাত্র কারণ, এতো দিনের সূর্যের মতো স্পষ্ট। আর এই সাহায্য পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিলেন কর্নেল কিয়ানীর মতো মুমিন পুরুষ ও আমাদের ভাঙ্গাচোরা ঈমানী জজবা। ওয়ালেসে তিনি বার বার বলছিলেন। বেটা! দুশমন পালাচ্ছে… দুশমন অন্ধ হয়ে গিয়েছে … আমার প্রিয় জোয়ানদের বলে দাও… নিজেদের পরাজয়ের বদলি নাও… কর্নেল কিয়ানীর এ শব্দগুলো আমাকে পাগল করে তুললো। আমি অনুভব করছিলাম, আমি আর রক্ত মাংসের সেই দেহ বিশিষ্ট মানুষ নই যা বোমা, গুলির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হবে। আপাদমস্তক রূহ-আত্মা বনে গেলাম আমি। আর এই রূহ বিদ্যুৎ চমকের মতো এগিয়েই যেতে লাগলো।…
হ্যাঁ, গত দুমাস ধরে লক্ষ করছি দুশমনের ঘাড় এখন আর আগের মতো অহংকারে বাঁকা হয় না। তাদের গলার সেই তেজও নেই এখন। ওরা বুঝতে পারছে আমাদেরকে ভুল বুঝে ওরা চরম ভুল করছে।…
পরিণামে শত শত সঙ্গী হারিয়েছে। হারিয়েছে ওদের দখলকৃত বিপুল পাহাড়ি এলাকা। এ দুআ করবেন আমাদের আত্ম মর্যাদা যেন আল্লাহ তাআলা এভাবে সমুন্নত রাখেন। আমৃত্যু বিজয়ের মালা আমাদের সঙ্গী করে দেন।
ইতি–
আপনার ছেলে জামশেদ গুলজার।