ফ্রান্সীয়রা শহর, উপশহর এমনকি গ্রাম পর্যন্ত গুপ্তচর ছড়িয়ে রেখেছিলো। কারো ওপর যদি সামান্য সন্দেহ হতো সে মুক্তিসেনাদের কোনধরনের সহযোগিতা করেছে, তাহলে তার পুরো গাষ্ঠিকে গ্রেফতার করে নির্যাতন চালানো হতো। ফ্রান্সীয়দের কোন দূর্গ যদি মুক্তিসেনাদের হাতে বিজিত হতো, তাহলে অন্যান্য শহরের মারাকেশী মুসলমানদের বহু ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে দিতো ফ্রান্সীয়রা।
তারপরও মুক্তিসেনাদের মনোবল ভাঙ্গেনি। তাদের সেনা ও অস্ত্র স্বল্পতাকে পূরণ করতো ঈমানদীপ্ত জযবা ও সংকল্প দ্বারা।
এর মধ্যে আবদুল করীম মানবতার আরেক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। সেটা হলো, মুক্তিসেনাদের হাতে অনেক স্পেনিশ ও ফ্রান্সীয় সৈন্য বন্দি ছিলো। এরা যুদ্ধবন্দি। যুদ্ধবন্ধিদের সঙ্গে সব শত্রুপক্ষই চরম অমানবিক আচরণ করে। চতুষ্পদ জন্তুর চেয়ে তাদেরকে নিকৃষ্টতর মনে করা হয়। যুদ্ধবন্দিকে সসম্মানে মুক্তি দেয়াতো দূরের কথা। কিন্তু আবদুল করীমের নির্দেশে যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করা হতো। ১৯২৫ সনে আবদুল করীম সব যুদ্ধবন্দিকে মুক্তি দেন। শুধু তাই না, নৌযানের ব্যবস্থা করে তাদেরকে সমুদ্র পার করে দেয়া হয়।
এদের মধ্যে কিছু কয়েদী তো মুসলমানদের ব্যবহারে এতই মুগ্ধ হলো যে, নিজেদের দেশে না ফিরে মুক্তিসেনাদের দলে যোগ দিলো এবং তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেদের সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পরলো১৯২৫ সনের সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রান্স ও স্পেনের সম্মিলিত হাই কমাও মুক্তিসেনাদের ওপর চূড়ান্ত হামলা করলো। এতে পুরো কামানবহর ও সবগুলো যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধের ইতিহাসে একে এক অমানবিক ও পৈশাচিক হামলা বলে আখ্যায়িত করা হয়। মুক্তিসেনাদের প্রতিটি মোর্চা ও ক্যাম্পগুলোতে যুদ্ধবিমান থেকে অনবতর বোমাবর্ষণ করা হয়।
জনবসতির কোথাও সামান্য সন্দেহ হলেই পুরো বসতিই বোমার আঘাতে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এছাড়াও হাজার হাজার সশস্ত্র ঘোড়সাওয়ার এই হামলায় অংশগ্রহণ করে। তারপরও মুক্তিসেনারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে লড়াই করতে চেষ্টা করলো। শত্রুদলকেও ছোট ছোট দলে বিক্ষিপ্ত করার সবরকম চেষ্টা চালিয়ে গেলো। কিন্তু শত্রুসেনা তাদের বিন্যাস সারির মোটেও রদবদল করলোনা।
গোলাগুলি ও অবিরাম বোমাবর্ষণ অব্যহত রাখলো। তাদের লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে মানুষ, চতুষ্পদ প্রাণী, পশু-পাখি এমনকি গাছপালাও বাদ গেলোনা। ব্যবসায়ীদের শত শত কাফেলা বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেলো। কোন নিরপরাধকেও তারা ছাড়লো না। মুক্তিসেনাদের সংখ্যা খুব দ্রুত কমে যেতে লাগলো। ইমোনেশনও খতম হয়ে গেলো। তারপর তারা তলোয়ার ও বর্শার সাহায্যে লড়তে লাগলো। কিন্তু এই আগুন ও রক্ত ঝড়ের সামনে তারা খড়কুটার মতো উড়ে গেলো।
মুক্তিসেনারা তো নিজেদের প্রাণ নিজেদের হাতে নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। কিন্তু শত্রুদল নর পিছাচের মতো এর শাস্তি দিচ্ছিলো নিরপরাধ শহরবাসীকে। তাদেরকে পাইকারি দরে হত্যা করা হচ্ছিলো। হত্যা করা হচ্ছিলো নারী ও শিশুদেরকেও। পরাজয় দেখা যাচ্ছিলো স্পষ্ট। কোথাও থেকে তো সাহায্যেল আশাই ছিলো না। আবদুল করীম সাধারণ মানুষকে নরপিশাচদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধবন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি শত্রু শিবিরে সাদা ঝাণ্ডাসহ এক লোককে পাঠালেন দূর হিসাবে। কিন্তু শত্রুপক্ষ যুদ্ধ বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানালো।
আবদুল করীমের সঙ্গে তখন খুব সামান্যই মুক্তিসেনারা রয়ে গিয়েছিলো। তাও প্রায় নিরস্ত্র। অবশেষে আবদুল করীম ১৯২৬ সনের এপ্রিয়ে এই ঘোষণা দিলেন,
মারাকেশের রক্ত একমাত্র আমার কারণেই ঝড়ছে। আর রক্ত ঝড়ছে তাদের, যারা লড়তে জানে না। আর যারা লড়তে পারতো তারা লড়তে লড়তে শহীদ হয়ে গেছে। তবে ইনশাআল্লাহ মারাকেশ একদিন অবশ্যই স্বাধীন হবে। সেটা খুব শিগগীরই হবে। আমি রণাঙ্গনে না থাকলেও এখন অনেক আবদুল করীম সূর্যোদয়ের মতো জেগে উঠবে। ওই রক্ত সাগরের ভেতরেই আমার পরের আবদুল করীম আমার কথা শুনতে পাচ্ছে। তারা যেদিন উঠে দাঁড়াবে, সেদিন আর ঐ জালিম-সন্ত্রাসী সাম্রাজ্যবাদীরা দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তাদের পায়ে লুটিয়ে পড়বে।
এই ঘোষণা দিয়ে তিনি ফ্রান্স ও স্পেনিশদের হেডকোয়ার্টারের দিকে হাঁটা ধরলেন। তিনি যখন সেখানে পৌঁছলেন, তখন তার মুখে এক চিলতে হাসি লেগেছিলো। তাকে দেখে ফ্রান্সের মার্শাল পেটীন ও স্পেনের মার্শাল প্ৰেমোদি রিভার একসঙ্গে সম্ভ্রমে স্যালুট করলেন এবং পরমুহূর্তেই তাকে গ্রেফতার করা হলো। এরপর তাকে তার পরিবারসহ রীইউনীন দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হলো।
তাঁকে নির্বাসনে পাঠানোর পরও স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন থেমে যায়নি। মাত্র তিনমাসের মাথায় ওরা আবার সুসংগঠিত হতে শুরু করলো। তারপর ১৯৫৬ সনের ৬ মার্চ মারাকেশ পূর্ণাঙ্গরূপে স্বাধীন হলো। আবদুল করীম যেদিন স্বাধীন মারাকেশে পা রাখলেন, সেদিনই মারাকেশবাসী স্বাধীনতা ও বিজয়লাভের আনন্দ উদযাপন করলো।
সেদিন সবার আনন্দ উচ্ছ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন আবদুল করীম।
লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের জনারণ্যে তিনি যেন এক দীঘল বৃক্ষ।