এর বিপরীতে মুক্তিসেনাদের সংখ্যা যেমন ছিলো কম, অস্ত্রশস্ত্র ছিলো আরো কম এবং উপায়-উপকরণও ছিলো সীমিত।
এত কিছুর পরও মুক্তিসেনাদের গেরিলা অপারেশন এতই সফল হলো যে, ফ্রান্সীয়রা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো। কারণ, ওরা যতই প্রস্তুতি নিয়ে রাখুক গেরিলা হামলায় তো এরা অভিজ্ঞ ছিলো না মোটেও। আর মুক্তিসেনারা প্রত্যেকেই চিলো গেরিলা অপারেশনের বিশেষজ্ঞ। দেখা গেলো, এই গেরিলা অপারেশনের কারণে ফ্রান্সীয়দের হাত থেকে অনেকগুলো চৌকি ছুটে গেছে।
কোথাও কোথাও তো ফ্রান্সীয় আর্মির সঙ্গে মুক্তিসেনাদের মুখোমুখি সংঘর্ষও হয়েছে। কিন্তু সেসব জায়গায় মুক্তিসেনাদের চরম আক্রোশ ও তীব্র হামলার সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।
ফ্রান্সীয়দের জেনারেল এখন লাইটে। লাইটে অতি চতুর জেনারেল ছিলেন। জেনারেল লাইটে মুক্তিসেনাদের বিরুদ্ধে মারাকেশের সেসব গোত্র সরদারদের ব্যবহার করতে চাইলো, যাদেরকে বহু টাকা-পয়সা, জায়গীর ও সুন্দরী নারীদেরকে দিয়ে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিয়েছিলো। জেনারেল লাইটে চাচ্ছিলেন এই সময় গোত্রগুলো যেন মুক্তিসেনাদের পক্ষে কাজ না করে।
এক সরদার তার গোত্রের সবাইকে বলে দিলো, তারা যেন ফ্রান্সীয়দের সঙ্গ দেয়। তাদের পক্ষে কাজ করে। কারণ মুক্তিসেনা নামের ঐ মুসলমানগুলো ডাকাত, ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসী। পরদিনই সেই সরদারের লাশ এমন বিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেলো যে, তার দুই পা, দুই হাত ও মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এদিক-ওদিক পড়ে ছিলো। আর সেগুলো কাড়াকাড়ি করছিলো শৃগাল, কুকুর।
অন্যসব সরদারকে কালো খামে করে এই পয়গাম দিলো,
তোমরা নিশ্চয় তোমাদের এক সঙ্গীর পরিণাম দেখেছো। মনে রেখো, তার দেহ থেকে তার পা দুটি ও বাহু দুটি তখনই কেটে পৃথক করা হয়েছিলো যখন সে জীবিত ছিলো আর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব মুহূর্তে তার মাথাটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যে এটা উপভোগ করতে চাও, সে সাহস করে একবার মুক্তিসেনাদের বিরুদ্ধে বলেই দেখো না।
এরপর আর কোন সরদার ফ্রান্সীয়দের সঙ্গ দিতেও কাউকে বলেনি এবং মুক্তিসেনাদের বিরুদ্ধে একটি শব্দ উচ্চারণ করেনি। এমনকি গোপনেও নয়।
ফ্রান্সীয়রা যখন দেখলো তাদের এ কৌশলও ব্যর্থ হয়েছে, তখন তারা স্পেনিশদের কাছে এ প্রস্তাব পাঠালো, মারাকেশের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এবং বিদ্রোহী মুক্তিসেনাদের উৎখাত করার এখন একমাত্র উপায় হলো, ফ্রান্স ও স্পেনের সম্মিলিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলা। সম্মিলিতভাবে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া।
স্পেন নিজেদের চরম পরাজয় থেকে বাঁচানোর জন্য সঙ্গে সঙ্গে এ প্রস্তাব লুফে নিলো। এর আগে কিন্তু ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে মিত্র সম্পর্ক ছিলো না। তাদের মধ্যে শীতল সম্পর্ক ছিলো। সঙ্গে সঙ্গে এ দুই দখলদার দেশ সম্মিলিত কার্যক্রম শুরু করে দিলো।
ওদিকে ফ্রান্স জেনারেল লাইটেক কমান্ডিং দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে মার্শাল পেটীনকে মারাকেশ পাঠালো। বৃদ্ধ মার্শাল পেটীন ছিলেন সর্বস্বীকৃত যুদ্ধগুরু। তার মতো এমন অভিজ্ঞ, তীক্ষ্মধারী কমান্ডার ফ্রান্স ও স্পেনে একজনও ছিলোনা। স্পেনও আরেক মার্শাল পাঠালো মারাকেশে। তার নাম মার্শাল প্রেমোদী রিভার। ইনিও ছিলেন অতি দক্ষ যুদ্ধবাজ নেতা।
এরা উভয়ে উভয়ের বাহিনীকে এক ছাউনিতে নিয়ে এলো। সম্মিলিত হাইকমান্ড হিসেবে তাদেরকে প্রস্তুত করে তোলা হলো। দুদেশই আরো অধিক সংখ্যক সেনা পাঠিয়ে দিলো। শুধু তাই নয়, ফ্রান্স তো যুদ্ধ বিমানও পাঠিয়ে দিলো মারাকেশে। আর পাঠালো বিমাল কামান বহর। যুদ্ধ বিমান ও কামানবহর মুক্তি সেনাদের জন্য ভয়ংকর অস্ত্র ছিলো।
তবে মুক্তিসেনারাও শত্রুর সেনাবিন্যাস অনুযায়ী নিজেদের সেনাবিন্যাস বদলে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে খোলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রাখলো। ওদিকে গেরিলা ও কমান্ডো অপারেশনও অব্যাহ রাখলো। এই গেরিলা ও কমান্ডো অপারেশন চালিয়ে মুক্তিসেনারা ফ্রান্সীয়দের রসদ সরবরাহের পথগুলো বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলো। দূরদূরান্তের চৌকি পর্যন্ত রসদ পৌঁছতে দিতো না মুক্তিরা।
শত্রুরা এবার রসদবহরের সঙ্গে আর্মি ইউনিটও পাঠাতে শুরু করলো। মুক্তিসেনারা তাদের ওপরও হামলা করে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো। এভাবে শত্রু সেনাদের বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হলো। কিন্তু ফ্রান্সীয়রা যখন রসদের বহরের সঙ্গে যুদ্ধ বিমানও পাঠাতে শুরু করলো, তখন তো মুক্তিসেনাদের জন্য টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়লো। মরুর খোলা আকাশের নিচে বিমান হামলা থেকে নিজেদেরকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। এভাবে শত্রুদল রসদ সরবরাহের পথ নিচ্ছিদ্র করে নিলো।
***
আবদুল করীম এবার নিজেদের হামলার ধরণ পাল্টে ফেললেন। মারাকেশে ছেষট্টিটি দুর্গ ছিলো। অনেক দুর্গ ফ্রান্সীয়রাও নির্মাণ করে। এসব দূর্গগুলো ছোট ও মাঝারি ধরনের ছিলো। শত্রুদল এগুলোকে প্রতিরক্ষা ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করলো। আর মুক্তিসেনারা এসব দূর্গের ওপর হামলা করতে শুরু করলো।
১৯২৪ সনের শেষের দিকে মুক্তিসেনারা নয়টি কেল্লা ফ্রান্সীয় ও স্পেনিশদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু বড় সংকট যেটা দেখা দিলে সেটা হলো, আবদুল করীমের সেনাসংখ্যা ক্রমেই কমে যেতে লাগলো। অস্ত্র ও গোলাবারুদের স্বল্পতাও অনুভূত হতে লাগলো। কারণ তাদের কাছে তো অস্ত্র তৈরির কোন ফ্যাক্টরী ছিলো না। অস্ত্র সরবরাহের মতো তাদের কোন মিত্র দেশও ছিলো না।