তোমরা অন্যের জিনিসের ওপর নির্ভর করে থেকো না। তোমাদেরকে যারা সাহায্য করবে তারা কোন না কোনভাবে এর চেয়ে দ্বিগুণ বিনিময় তোমাদের থেকে আদায় করে নেবে। হতে পারে, এর বিনিময়ে তোমাদের থেকে তোমাদের স্বাধীনতার চেতনাই ছিনিয়ে নেবে। কিংবা ছিনিয়ে নেবে তোমাদের থেকে তোমাদের বুকে আগলে রাখা ঈমানের দীপ্তি।
চৌদ্দ বছরের এক ছেলে তো মুক্তিসেনাদের দূরদূরান্তের ক্যাম্পগুলোর মধ্যে টেলিফোন লাইনের ব্যবস্থা করে ফেললো। শত্ৰুদলের বিভিন্ন সেনা চৌকি ও ফৌজি কাফেরার ওপর হামলা করে করে মুক্তিসেনারা অনেক যুদ্ধ। সরঞ্জাম সংগ্রহ করে। এর মধ্যে অসংখ্য ক্যাবল টেলিফোন তার ও অসংখ্য টেলিফোন সেটও ছিলো।
মুক্তিসেনাদের জন্য এ জিনিসগুলো বেকার ছিলো। কারণ, তারা এই ব্যবহার জানতো না। কিন্তু চৌদ্দ বছরের এক ছেলে এগুলোকে মহামূল্যবান করে তুললো। সে টেলিফোন সিস্টেমের খুঁটিনাটি বিভিন্নভাবে শিখে নিলো। তারপর বহু কষ্ট করে ব্যাটারীরও ব্যবস্থা করলো। এরপর শক্তিশালী কিছু সৈনিকের সাহায্যে মাটির নিচ দিয়ে প্রয়োজনীয় জায়গাগুলোতে টেলিফোন সিস্টেম চালু করে দিলো।
এতে আবদুল করীম ও তার জানবার্য দলের জন্য দারুন সুবিধা হয়ে গেলো। তারা জায়গায় বসে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা পেয়ে যেতো। অনেক সময় বাঁচতে এবং দুশমনের ওপর হামলাগুলোও হতো দারুন সময়োপযোগী ও কঠোর। কিছু দিনের মধ্যে টেলিফোন সিষ্টেমকে এমন সক্রিয় করে তোলা হলো যে, যেখানেই প্রয়োজন হতো মুক্তিসেনারা সেখানেই টেলিফোন সিষ্টেম চালু করে নিতো।
মুক্তিসেনাদের হামলা, নৈশ হামলা ও গেরিলা হামলা এত ঘন ঘন ও তীব্রতর হয়ে উঠলো যে, শহর থেকে দূরের স্পেনিশ ফৌজের চৌকিগুলো সব খালি হয়ে গেলো। এসব চৌকির অধিকাংশ আর্মিই মারা গেলো। এই চৌকিগুলো শূন্য হওয়ায় স্পেনিশদের জন্য দূরদূরান্ত পর্যন্ত রসদ পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়লো। কারণ স্পেনিশদের রসদবাহী গাড়িগুলো মুক্তিসেনারা খুব সহজেই ছিনিয়ে নিতো।
এমনকি শহরগুলোতেও স্পেনিশ পৌজের পক্ষে টিকে তাকা মুশকিল হয়ে পড়লো। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক শহরের অধিকাংশ শহরবাসীই মুক্তিসেনাদের পক্ষে নেয়া শুরু করলো। অথচ এটা ছিলো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থা নেয়া ও সরকারকে অসহযোগিতা করার মতো মারাত্মক অপরাধ। এই ঝুঁকি সত্ত্বেও শহরে লোকেরা স্পেনিশদের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিসেনাদের পক্ষে কাজ করতে শুরু করলো।
সব জায়গাতেই স্পেনিশরা এমন কোনঠাসা হয়ে গেলো যে, স্পেনিশদের শাসন কার্যত খতম হয়ে গেলো। মুক্তি সেনাদের শাসন চলতে লাগলো স্পেনিশ অধ্যুষিত মারাকেশে। কাগজের খাতায় শুধু স্পেনিশদের শাসনকার্য ছিলো। যেটার দুপয়সারও মূল্য ছিলো না। এটা ছিলো আসল মুক্তিসেনাদের সুস্পষ্ট বিজয়।
এখানে যত সহজে বলা হচ্ছে এ বিজয়ের কাহিনী এত সহজে রচিত হয়নি। হাজার হাজার মুক্তিসেনাদের শাহাদাতবরণ করতে হয়েছিলো।
অসংখ্য নৈশ গেরিলা হামলা চালানো হয়েছিলো। এর প্রতিটি হামলায় একাধিক মুক্তিসেনা শহীদ হয়েছে। আহত হয়েছে অনেক। এর মধ্যে কারো কারো এক বা একাধিক অঙ্গহানিও ঘটেছে। মুক্তিসেনাদের মধ্যে কমবয়সী ছেলে-মেয়েও ছিলো। এদের মধ্যে যারা শত্ৰুদলের হাতে ধরা পড়তো তাদের এমন পৈশাচিক কায়দায় শাস্তি দেয়া হতো যে, তা দেখে অনেক স্পেনিশ সৈনিক আর্মি ছেড়ে চলে গেছে, না হয় নিজেদের ধর্মত্যাগী হয়েগেছে।
এসব ছেলে-মেয়ের পরিবারের লোকদেরকেও ক্ষমা করা হতো না। ঘরের নারী শিশুদেরকেও প্রহার করা হতো, অপদস্থ করা হতো। আর যুবতী মেয়ে থাকলে তো ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যেতো, তাদের দেহের রক্তের প্রতিটি ফোঁটা ঝড়িয়ে ঝড়িয়ে ওদেরকে মারা হতো।
মারাকেশের বালুকণা মুক্তিসেনা ও তাদের পরিবার-আপনজনদের রক্তে কর্দমাক্ত হয়ে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে স্পেনিশ ফৌজের হাড়গোড়ও মরুভূমিতে তুপিকৃত হতে থাকে।
মারাকেশ এভাবে তার বন্ধু ও শত্রুদের রক্তে ডুবে যায়। এভাবে স্পেনিশদের দখলকৃত মারাকেশের পরাধীন এলাকাগুলো স্বাধীন হওয়ার পূর্ণাঙ্গ পথে রূপান্তরিত হয়। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার বাকি।
***
দীর্ঘ গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্ত হওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন। এসময় আবদুল করীম রণাঙ্গনীয় এক কৌশলগত ভুল করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এ সময় তার উচিত ছিলো, স্পেনিশ অধ্যুষিত এলাকা ও শহরগুলোতে নিজেদের পূর্ণাঙ্গ দখলদারিত্ব নিশ্চিত করা। সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলা এবং সুশৃঙ্খল সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিজেদের বিজিত এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া। এরই ভিত্তিতে গড়ে উঠতো নিজেদের স্বাধীন শাসন ব্যবস্থা, স্বাধীন রাষ্ট্র এবং মুক্ত ও স্বাধীন নাগরিক সত্ত্বা।
স্পেনিশদের পিছু হটিয়ে এবং নিজেদের বিজয় সুনিশ্চিত হওয়ায় আবদুল করী ও তার সেনাদের মনোবল এতই বেড়ে গেলো যে, কিছু বাস্তবতা তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেলো। তাদের জযবা নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়লো। তারা এবার ফ্রান্সীয় ফৌজের ওপর হামলা শুরু করলো।
ফ্রান্সীয়দের ওমর হামলার ব্যাপারে নৈশ ও গেরিলা হামলার কৌশলও অবলম্বন করলো। এ পদ্ধতি অবলম্বন করে স্পেনিশদের বিরুদ্ধে এরা সফল হয়েছে দারুনভাবে। কিন্তু ফ্রান্সীয়রা স্পেনিশদের এই পরিমাণ দেখে আগ থেকেই ভিন্ন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো। তাদের তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেক শক্তিশারী করে রাখে। জবাবী হামলার ব্যবস্থাও করে রাখে। এছাড়াও ফ্রান্সীয়রা সৈন্যবল ও অস্ত্রবলে স্পেনিশদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলো। মারাকেশের দখলকৃত এলাকাও ছিলো বেশি।