কারো কারো জ্বালাতন অনেক সময় মধুর চেয়ে ভালো লাগে। বুঝলে আয়মান! এমন মধুর জ্বালাতন আমরা সবসময় উপভোগ করতে চাই। সরদার রহস্যময় কণ্ঠে বললো।
মধুর জ্বালাতন? কথাটার মানে কি?
সব কথার মানে না বুঝলেও চলবে। ওহ, রাখো আমার একটা কাজ আচে। তুমি তোমার ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো। সময় হলে আমি তোমাকে ডাকবো। এখন যাও।
আয়মান ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সরদার লোক মারফত গোত্রের কয়েকজনকে ডেকে বললো, আমাদের ক্যাম্পে চলে যাও। কমাণ্ডার আবদুল করীমকে সালাম জানিয়ে বলবে, আজ রাতে যদি উনি এখানে একটু সময় নিয়ে আসেন তাহলে আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো।
ওরা বেরিয়ে যেতেই সরদার তার মেয়ে জুমানাকে ডাকলো। জুমানা পাশের ঘরেই ছিলো এতক্ষণ।
আয়মানের সঙ্গে এতক্ষণ যে কথাবার্তা হয়েছে তা তুমি নিশ্চয় শুনেছো। সরদার বললো।
হ্যাঁ বাবা! শুনেছি আমি। কিন্তু তুমি সেটা বুঝলে কি করে? জুমানা বললো।
আমি সেটা না বুঝলে এত বড় গোত্রের সরদার করি কি করে? এখন আমি কি করতে যাচ্ছি তুমি নিশ্চয় সেটা বুঝতে পারছে। সরদার মেয়ের দিকে ঝুঁকে এসে বললো।
হয়তো বুঝতে পারছি।
তোমার কি এতে ভিন্ন কোন মতামত আছে? কিংবা কোন আপত্তি?
বাবা! তুমি নিশ্চয় জানো তোমার মতামতই আমার মতামত। তবে আমার জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি কি এক তরফা এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছো? উনার সঙ্গে তো মনে হয় এ ব্যাপারে কোন আলাপ করোনি। যতটুকু শুনেছি উনি তো আমাদের এখানে থাকতেই অনীহা দেকাচ্ছিলেন।
শোন মা! আয়মানের এই অনীহাকেই আমি সম্মতি বলে ধরে নিচ্ছি। আর ওর সঙ্গে সরাসরি কতা না হলেও চোখে চোখে এবং মনে মনে কথা হয়ে গেছে। আশা করি আমার ও তোমার উভয়ের ধারণার চেয়ে ওকে তুমি অনেক অলে সঙ্গী হিসেবে পাবে।
জুমানার মুখখানি লাল হয়ে উঠলো, চোখ দুটো হয়ে উঠলো অশ্রুসিক্ত। আলতো করে ঠোঁটজোড়া নড়ে উঠলো। কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না।
***
ঘন্টা তিনেক পরের ঘটনা। কমান্ডার আবদুল করীমসহ গোত্রের অন্যান্য গণ্যমান্য লোকদের উপস্থিতিতে হুজ্জুল আয়মান ও জুমানার মধ্যে বিয়ে পরিয়ে দেয়া হলো। সরদার সাজিদ সারহী এই বিয়ে হওয়াতে এত খুশি হলো যে, কেঁদে ফেললো। আবেগৰুদ্ধ কণ্ঠে বললো,
তোমরা সবাই জানো, এ আমার আনন্দ-অশ্রু। আমার এই পার্থিব জীবনের সব চাওয়া পাওয়া পূর্ণ হয়ে গেছে। শুধু একটা চাওয়াই বাকি আছে। একটা স্বপ্নই অপূর্ণ রয়ে গেছে এখনো। সেটা হলো মারাকেশের স্বাধীনতা। আল্লাহ তাআলার কাছে আমার এখন একটাই প্রার্থনা, শহীদ ও গাজী মুক্তিসেনাদের জান বাজি লড়াইয়ের বিনিময়ে যেন মহান আল্লাহ আমাদেরকে স্বাধীনতা দান করেন। এখন আর আমার কোন পিছুটান নেই। এখন আমি নিশ্চিন্তে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবো।
সবাই জয়ধ্বনি করে উঠলো। কেউ কেউ তকবীর ধ্বনিও দিলো।
প্রিয় ইসলামের সৈনিকরা! মুক্তিকামী যোদ্ধারা! আবদুল করীম দাঁড়িয়ে বললো, যেখানেই ইসলামের আবেদন পুর্ণাঙ্গভাবে চর্চার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানেই মুসলমানদের মধ্যে দান করা হয়েছে ঐক্যের শক্তি। আজ দেখো, আমরা লড়াইয়ের রক্তাক্ত ময়দানে থেকেও হাসতে পারি। যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যেও ভালোবাসা ও প্রেমের পরম সৌধ নির্মাণ করতে পারি আমরা। এই আয়মান ও জুমানার বিয়েটাও এরই জ্বলন্ত প্রমান…।
বন্ধুরা! মনে রেখো, আমাদের এ ঐক্য যদি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারি তাহলে আমরা ঐ বিজাতীয় দখলদারদের কবল থেকে একদিন না একদিন ইনশাআল্লাহ মারাকেশ স্বাধীন করতে পারবো। এটা ঠিক যে আমাদের সৈন্যবল, অস্ত্রবল সব কিছুই ওদের তুলনায় বলা যায় হাস্যকর। কিন্তু এক আল্লাহর প্রতি আমাদের ঈমান-বিশ্বাস বহুগুণ বেশি। এই প্রদীপ্ত বিশ্বাসের গৌরবই বিজয়ের মাল্য পরিয়ে একদিন আমাদেরকে গৌরাবাৰত করবে। নারায়ে তাকবীর- আল্লাহ আকবার।
সরদার সাজিদ সারহী ঘোষণা দিলেন, আগামীকাল দুপুরে এই গোত্রের সবার এবং সব মুক্তিসেনাদের ওলিমার দাওয়াত।
আয়মান ও জুমানা বাসর রাতে যে অনাগত সন্তানের স্বপ্লবীজ রোপন করেছে, সে সন্তানকে তারা উৎসর্গ করলো মারাকেশের স্বাধীনতার নামে।
***
আবদুল করীম ও তার মুক্তিসেনাদের খ্যাতি এখন আর মারাকেশেই সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও আবদুল করীমের বীরত্বগাঁথা ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি বৃটিশরা তাকে গোপনে অস্ত্র ও সনাসাহায্য দেয়ার প্রস্তাব করে। জার্মানিও একই ধরনের প্রস্তাব পেশ করে। ইউরোপের আরো কয়েকটা দেশ নানান ধরনের প্রলোভন দেখায়। কিন্তু আবদুল করীম এসবই কৌশলে প্রত্যাখ্যান করে।
কারণ, আবদুল করীম জানতো, এরা কেউ বন্ধু নয়। বন্ধুবেশে এরাও মারাকেশ দখল করতে চায়। তার একমাত্র নির্ভরতা ছিলো আল্লাহ তাআলা ও তার অমিত আত্মবিশ্বাসের ওপর মুক্তিসেনাদের মধ্যে এমন কিছু লোক পাওয়া গেলো, যারা প্রযুক্তি ও ইলেক্ট্রিক্যাল বস্তুসামগ্রী বানাতে সিদ্ধহস্ত ছিলো। তারা শত্রুপক্ষের অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম দেখে দেখে সেগুলো নিজেরা তৈরি করতে লাগলো। হাতবোমা, গ্রেনেড, শটগান, রাইফেল, এলএমজি, ক্লাশিনকোভ জাতীয় অস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ সরঞ্জাম এই এক্সপার্টরা বানাতে শুরু করলো। এতে তাদের প্রাথমিক অস্ত্র স্বল্পতার সমস্যা কিছুটা লাঘব হলো। তবে মুক্তিসেনারা সেসব অস্ত্রই বেশি ব্যবহার করতো যেগুলো স্পেনিশদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে। তারপরও আব্দুল করীম মুক্তিসেনাদেরকে সবসময় অস্ত্র তৈরিসহ বিভিন্ন শৈল্পিক কাজে উৎসাহ দিতো। আব্দুল করীম তাদেরকে বলতো,