বাবা! এখন কেমন লাগছে জুমানা বলতে বলতে প্রায় কেঁদে ফেললো।
ঘাড়ডিয়োনা বেটি। আমি এখন অনেকটাই সুস্থ। শুধু মাথার বাম দিকটা একটু চিনচিনে ব্যথা আছে। বলতে বলতে সরদার উঠে বসলো।
আরে উঠছো কেন? যখমের ক্ষতি হবে তো?
কিছুই হবে না মা! শোয়র চেয়ে বেস থাকতেই ভালো লাগছে।
জুমানা লক্ষ্য করলো, আসলেই তার বাবাকে এখন অনেকটাই সুস্থ লাগছে। আগেই স্যুপ বানিয়ে রেখেছিলো। সেটা যত্ন করে তার বাবাকে খাইয়ে দিলো। তারপর দুধ মধু মিশ্রণে ঔষধ খাইয়ে দিলো।
বাবা! এখন কি একটু ভালো লাগছে।
হা মা! এখন বেশ চাঙ্গা বোধ করছি। জুমানা! আয়মান কোথায়?
সম্ভবত ক্যাম্পে চলে গেছে।
সেকি ওকেও তো কমান্ডার দুএকদিন বিশ্রামে থাকতে বলেছে। তাহলে ক্যাম্পে চলে গেলো কেন? তুমি ওর সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করেছো?
সে কি বাবা! আমাকে তুমি এত অভদ্র মেয়ে মনে করো? আহত গলায় বললো জুমানা।
না, মানে তুমি একদিন ওর ব্যাপারে অনেক অভিযোগ করেছিলে।
তখন তো ওর ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। তা ছাড়া আজ তো আর কোন অভিযোগ করিনি।
তাহলে মা! এখন ওর ব্যাপারে কি জানতে পেরেছে?
কেন তুমিই তো সেদিন ওর ব্যাপারে লম্বা বক্তৃতা দিলে। আর কাল রাতে ও যে যত্ন নিয়ে তোমাকে এখানে এনে শুইয়ে দিয়েছে, তোমার ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করেছে এবং আন্তরিকতা দেখিয়েছে এটা দেখে আমি বুঝতে পেরেছি, উনি অত্যন্ত ভালো মানুষ। শেষের কথাগুলো জুমানা লাজুক কণ্ঠে বললো।
হ্যাঁ, আমি অনুমান করেছিলাম তুমি নিজেই একদিন ওর ব্যাপারে প্রশংসার সার্টিফিকেট দেবে। সরদার সাজিদ সারহী খুশি হয়ে বললো, কিন্তু আসল ঘটনা শুনলে না জানি কোন সার্টিফিকেট দেবে।
আসল ঘটনা? জুমানা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো।
হ্যাঁ, ঘটনা হলো, কালকের গেরিলা হামলায় যদি আয়মান না থাকতো এবং ঘটনাস্থলে বিদ্যুত্রে মতো ছুটে না যেতো তাহলে হয়তো তোমার বাবা লাশ হয়ে যেতো।
বলো কি বাবা! বিস্ময়-আতঙ্কে জুমানার চোখ স্থির হয়ে গেলো।
একে তো রাতের অন্ধকার সরদার সাজিদ সারহী আবার বলতে শুরু করলো, মশালের আলোয় কাছের জিনিসই তো আবছা দেখা যায়। দূরের জিনিস কুব কমই ঠাহর করা যায়। তারপর আবার আমার সাথী সঙ্গীরা লড়াইয়ে ব্যস্ত। কারো দিকে তো কারো কোন মনোযোগ থাকার কথা নয়। হঠাৎ আমার ওপর দুই স্পেনিশ আর্মি ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই মাথায় আঘাত করলো সম্ভবত রাইফেল দিলে। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেলাম। মনে হয়েছিলো মাথাটা যেন চৌচির হয়ে গেছে। সারা দুনিয়া ঘুরতে লাগলো। এ সময়ই সেখানে আয়মান উপস্থিত হলো। কিন্তু ইতিমধ্যে আরো কয়েকটি আঘাত খেয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। তারপর আয়মান আমাকে কিভাবে ওদের হাত থেকে উদ্ধার করেছে, কি করে ক্যাম্পে নিয়ে এসেছে, এর কিছুই মনে নেই।
… আহা ছেলেটাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিতে পারলাম না।
ধন্যবাদ তো আমিও দেইনি। জুমানা বললো, ঘটনা আমাকে উনি বলার সময় তো উনার নামটি একবারও বলেননি। বাবা! সত্যি কথা বলতে কি তোমাকে বাঁচানোর চেয়ে এভাবে নিজের কথা চেপে রাখার ব্যাপারটি আমার কাছে অনেক বেশি বিস্ময়কর লাগছে। এ ব্যাপারটি আকামে অভিভূত করেছে।
এ ধরনের ছেলেরা অন্যের বিপদে নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে সহজেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। এটা যে কত বড় বীরত্বপূর্ণ ও কৃতিত্বপূর্ণ কাজ সেট আর ওরা মনে রাখে না। নয়তো এ কারণেই আমাকে বাঁচানোর ব্যাপারটি এ কাছে মামুলি ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাই র নামটিও তোমাকে বলা প্রয়োজন বোধ করেনি।
***
আরে তুমি এখন ক্যাম্পে কেন? আবদুল করীম হুজ্জুল আয়মানকে ক্যাশে দেখে বললো। তোমাকে তো কাল পর্যন্ত বিশ্রামে থাকতে বলা হয়েছে। গতকাল যারা নৈশ হামলায় ছিলো তাদের সবার জন্য একই ব্যবস্থা। যাও, তুমিও বিশ্রাম কারো গিয়ে।
না, মানে ওখানে ভালো লাগছিলো না। তাই ভাবলাম ক্যাম্পে এসে একটু ঘুরে যাই।
আরে এত দিন ভালো লাগলো আজ আবার কি হলো? ঠিক আছে ক্যাম্পেই কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও। বিকালে সরদারে বাড়ি চলে যেয়ো। যতটা সম্ভব বিশ্রাম নিয়ে শরীর ঝরঝরে রাখতে হবে। হয়তো এমনও সময় আসবে যে, মুহূর্তের জন্য দুচোখ এক করার সুযোগ পাবে না।
আয়মান কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবদুল করীম অন্য সেনাদের দিকে মনোযোগ দিলো।
সরদারের বাড়িতে আয়মান সন্ধ্যার দিকে ফিরলো। সরদারের ঘরে জুমানা বসা ছিলো। আয়মানের উপস্থিতি টের পেয়ে অন্য ঘরে চলে গেলো। আয়মান সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকলো।
এখন কেমন আছেন সরদার? আয়মান ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলো।
এসো, বেটা! বসো এখানে। সরদার শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বললো, এখন বেশ ভালো আছি। দুপুরের দিকে মাথায় একটা চিনচিনে ব্যথা ছিলো। এখন সেটাও নেই। শুধু চাপ লাগলে ব্যথা করে। শরীরের দুর্বলতাও খুব একটা নেই। কালকের মধ্যে দাঁড়িয়ে যেতে পারবো। তা তুমি কি ক্যাম্পে গিয়েছিলে? তোমার ন আজ বিশ্রামে থাকার কথা! না কি এখানে থাকতে কোন অসুবিধা হচ্ছে।
না, শুয়ে বসে থাকতে কত ভালো লাগে? তাই ক্যাম্প থেকে ঘুরে এলাম। আর এখানে থাকতে অসুবিধা কি হবে? আপনাদের যত্ন ও আন্তরিকতায় বেশ সুখেই আছি। আরামে থাকতে থাকতে বরং শরীর ভারি হয়ে গেছে। একজন সৈনিকের জীবনে এত আরাম আয়েশ থাকা ঠিক নয়। আর অনেক দিন থেকেই তো আপনার এখানে রইলাম। অনেক জ্বালাতন করেছি এতদিন। তবে আজীবন আপনাদের আতিথেয়তার কথা মনে থাকবে।