না, ধন্যবাদ! এখন ঘুমুলে ফজরের সময় আর উঠতে পারবো না। ঠিক আছে, আপনি এখানে বসে থাকুন। আমি বাইরে গিয়ে বসি। একথা বলতে বলতে আয়মান বাইরে চলে গেলো।
না, আপনি ভেতরেই বসুন। বাইরে কুয়াশা পড়ছে … এতটুকু বলে জুমানা বুঝতে পারলো ঘরের ভেতর সে লোকটি আর নেই। তার মুখ খোলর আগেই বাইরে চলে গেছে।
জুমানা চেয়ার থেকে উঠ আলতো পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। বাইরে উঁকি দিলো। ভোরের আবছা আলোয় দেখতে পেলো, ঘরের সামনের টিলার ওপর একটা মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। মানুষটি বসে আছে। জুমানা আবার ঘরের ভেতর চলে গেলো। চেয়ারে বসে পড়লো। তার বাবা একটু নড়ে উঠলো এ সময়। পাশ ফিরতে চাচ্ছে। জুমানার সাহায্যে ঘুমন্ত অবস্থাতেই পাশ ফিরলো ডান দিকে। চোট পেয়েছে মাথার বাম দিকে।
জুমানা লক্ষ্য করলো, তার বাবার ঠোঁট দুটি নড়ছে। কিন্তু একটা বলছে হয়তো। তার মুখের কাছে জুমানার কান নিয়ে গেলো। তার বাবা বিড় বিড় করছে,
আয়মান। … আ… আ.. জু.. জুমানকে … দেখো… দুবার এমন বিড় বিড় করেই তার বাবা আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
জুমানা বুঝতে পারলো, হামলার সময়ের ভয়াবহ কোন দৃশ্য মনে হয় স্বপ্নে হানা দিয়েছে। কিন্তু আয়মানের কথা যে বললো তার বাবা সেটার কারণ কী? তাহলে কি আয়মানই হামলাকারীদের হাত থেকে তার বাবাকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু আয়মান তো ঘটনা বলার সময় একবারও তার ভূমিকার কথা বলেনি! এর রহস্য কী?
***
বাইরের প্রকৃতি আলো আঁধারিতে বেশ বৈচিত্র্যময়। এর মধ্যে আবার কুয়াশার হালকা চাদর খণ্ড খণ্ড ভাবে চারদিক আলতো করে ঢেকে রেখেছে। গ্রীষ্মের শেষ দিক এখন। পাহাড়ি এলাকাহওয়াতে এখানে এভাবে এসময় কুয়াশা পড়ছে।
সরদারের বাড়িটি মাঝারি ধরনের একটি পাহাড়ের নিচে। এই পাহাড়ের আশেপাশেই তার গোত্রের লোকেরা বসবাস করছে। পাহাড়ের ডানে-বামে ও সামনের দিকে উঁচু নিচু বেশ কিছু টিলা রয়েছে। দুএকটি টিলা শিলাপাথরের। একেবারে ন্যাড়া, তৃণ লতাহীন। আর অন্যগুলো বৃক্ষলতার ছাওয়া। দারুন সবুজ। অপরূপ দৃশ। কুদরত যেন নিজ হাতে এখানে নিসর্গকে সাজসজ্জা পরিয়েছে। আয়মানের কাছে জায়গাটি বেশ লাগে।
বাড়ির সামনের একটি টিলার চূড়ায় গিয়ে বসলো আয়মান। এসময় এখানে এসে বসার কোন অর্থ নেই। আয়মান বসতেও না। আসলে একটু নির্জনতার ছোঁয়া পাওয়ার জন্য আয়মানের মন উসখুস করছিলো। গত কয়েক মাসে ওর জীবনে যা কিছু ঘটেছে গত একত্রিশ বছরের জীবনের অতীতের সঙ্গে যেন এর কোন তুলনাই হয় না।
স্পেনিশ কাম্প থেকে ফেরার হয়ে মুসলিম ক্যাম্পে আসা, এখানে এসে মুসলমান হয়ে যাওয়া, আবদুল করীমের সান্নিধ্যে নিজের স্পেনিশ আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করা। তারপর এই সরদার সাজিদ সারহীর সঙ্গে পরিচয়-ঘনিষ্টতা, অবশেষে সরদারের আহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার মেয়ে জুমানার মুখোমুখি হওয়া- এসবকিছুই যেন ওর কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে।
আর এখন ওর মনে জুমানার অস্তিত্ব এসবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে। ওর আগের জীবন হলে জুমানা খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ কিছু ছিলো না। কারণ আয়মানের পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছে সে রক্ষণশীল বলে পরিচিত ছিলে। মদ ও নারীর ব্যাপারে ও খুব সংযমী ছিলো। তারপরও ওর গোটা চারেক মেয়ে বন্ধু ছিলো। ওরাও কারো চেয়ে কেউ কম সুন্দরী ছিলো না। কিন্তু ওদের সঙ্গে জুমানাকে কোনভাবেই যেন মেলানো যায় না। হঠাৎ জলোচ্ছাস যেমন মুহূর্তেই সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে হঠাৎ করেই আবার নেতিয়ে পড়ে। ওদের প্রেম, ভালোবাসা, উচ্ছ্বাস এমন হঠাৎ জলোচ্ছ্বাসের মতোই।
আর জুমানাকে গভীর কোন জলপ্রপাত বা বিশাল কোন দীঘির সঙ্গেই তুলনা করা যায়। যার মধ্যে আনন্দময়ী তরঙ্গ আছে, উচ্ছ্বাস আছে, আছে প্রবাহের অবিরত ধারা।
আয়মান ভাবছে, যত কিছুই হোক এমন নির্জনে এবং সহানুভূতির একটা পরিবেশে এমন একটা মেয়েকে পেয়ে কেউ সুযোগ নিতে ছাড়তো না। কমপক্ষে দুটো ভালো লাগার কথাও বলতো। দীর্ঘ সময় তার সঙ্গ উপভোগ করতো। আয়মান যে তা করেনি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে, এটা তার জীবনে একটা অভাবিত ঘটনা। সন্দেহ নেই, ইসলামই তার মধ্যে এই অমিত শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে।
আয়মানের মধ্যে হঠাৎই আরেক প্রশ্ন জেগে উঠলো, সরদারের বাড়িতে সরদার ছাড়া তার একমাত্র মেয়ে, একজন গৃহপরিচারিকা ও দুজন কাজের লোক- এ কজনই সদস্য। ওরা থাকে বারি বাইরে ভিন্ন কোঠায়। সরদার ও তার মেয়ে থাকে বাড়ির ভেতরে। আয়মানের জন্যও বাড়ির ভেতরই ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেকগুলো রুম রয়েছে বাড়ির ভেতরেও। এখানে একজন কেন নিয়মিত কয়েকজন অতিষি এতে থাকতে পারে। কিন্তু এমন একটা মেয়ে থাকতে আয়মানের কি এখানে একা একা থাকাটা ঠিক।
অবশ্য ওর প্রতি সরদারের শতভাগ আস্থা আছে। কিন্তু ওর নিজের প্রতি নিজের আস্থা কতটুকু? না, ওর আর এখানে এভাবে থাকাটা ঠিক হবে না। সরদারের অবস্থা একটু ভালো হলেই ও ক্যাম্পে থাকা শুরু করবে।
***
বেলা এগারটা নাগাদ সরদারের ঘুম ভাঙ্গলো। জুমানা তার বাবার মাথার কাছের চেয়ারে বসা ছিলো। তার বাবাকে নড়তে দেখে এবং চোখ খুলে তাকাতে দেখে উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলো,