প্রিয় শ্রদ্ধাস্পদ মা!
আসোলামু আলাইকুম
আশা করি আপনি সুস্থ আছেন। আমাদের এখানকার পরিস্থিতি অনেকটা ঘোলাটে। শিগগিরই এখানে লড়াই বেধে যাবে। অবশ্য এ নিয়ে আমাদের কোন দুশ্চিন্তা নেই। আমরা তো আমাদের সবকিছু আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে রেখেছি। আল্লাহ তাআলা চাইলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা আমাদের ও ইসলামের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে যাবো। আমার নয়নের মনি! আজ আমি আপনার দুআর কাঙাল। আল্লাহ তাআলা আপনার জীবনকে সম্মানিত করুন। আল্লাহ তাআলা যদি এবার আমাকে কবুল করে নেন তাহলে আপনি শোকাহত হবেন না। এমন হলে নিশ্চিত জানবেন আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা এমনই ছিলো। সন্তানের কিছু হলে মা বাবার জন্য তো তা মেনে নেওয়া বড় কষ্টদায়ক হয়। কিন্তু এতে তো কারো হাত থাকে না। তবে এটা তো নিশ্চিত আল্লাহ তাআলা যাকে শহীদী জীবন দেন সে তো বড় সৌভাগ্যবান।
আসগর, জানো, খানো,– ওরা তো আপনার সন্তান। আশা করি ওরা সবাই আপনার স্নেহাধীন– অনুগত।
প্রিয় আম্মাজান! আপনার কাছে সর্বশেষ আর্তি। আপনি আমার প্রতি সব সময় সন্তুষ্ট থাকবেন। ইনশাআল্লাহ পরকালেও আমি আপনার অনুগত থাকবো।
ইতি–
আপনার নয়নের মণি
হক নেওয়াজ কিয়ানী।
সেদিনই তিনি ইংরেজীতে তার ছেলে আসগর নেওয়াজ কিয়ানীকে একটি চিঠি লিখলেন। আসগর তখন মিলিটারী কলেজের ছাত্র। সেনাবাহিনীর অফিসার পদে কমিশন লাভের জন্য আগেই দরখাস্ত দিয়ে রেখেছিলেন। তাকে দারুণ তাৎপর্যপূর্ণ একটি চিঠি লেখলেন।
লিপা উপত্যকা
১মে ১৯৭২
আমার কলিজার টুকরো বেটা! আল্লাহ তাআলা সব সময় তোমার সঙ্গে থাকুন। তোমাদের সবার কাছ থেকে বিদায়ের সময় আমি তোমার কামিয়াবী ও আনন্দময় ভবিষ্যতের জন্য দুআ করছি। সেনাবাহিনীর অফিসার হওয়ার সুবাদে নিজের মধ্যে কঠোর পরিশ্রমের অভ্যাস গড়ে তোলো। দায়িত্বের প্রতি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করো। নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের জীবন যৌবনকে ব্যবহার করবে। অধীনস্ত জোয়ানদেরকে এবং নিজেকেও নিজের কমান্ডো রাখবে। সব সময় ইসলামের নামে প্রাণ উৎসর্গের জন্য প্রস্তুত থাকবে। নিজের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ দীক্ষা অর্জন করে নিয়ে। প্রতিটি পরিস্থিতির অণু বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা অর্জন করো, যাতে তুমি একজন সুযোগ্য অফিসার হতে পারো।
বেটা আমার! মনে রেখো খুব দ্রুত আমার স্থানে তোমাকে বসতে হবে। আমি এমন সময় তোমার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি যখন তুমি মাশাআল্লাহ পরিণত বয়সে পৌঁছে গেছে! যখন তোমার দাদাজান বিদায় নিয়েছেন তখন আমি অনেক ছোট। তবুও আমাকে অনেক কিছু সামলে উঠার গুরু দায়িত্ব নিতে হয়েছিলো। তোমার মা বোন ভাইদের প্রতি খেয়াল রেখো। ওদের সঙ্গে কঠোরতা করো না।
ইতি–
তোমার বাবা হক নেওয়াজ।
তার বড় ভাইকেও সেদিন ইংরেজীতে একটি চিঠি লিখেন।
শ্রদ্ধেয় ভাইজান!
আপনার প্রতি যে আমি কতটা কৃতজ্ঞ তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এই প্রৌঢ় বয়সের ভঙ্গুর শরীরে আমার ও আমার পরিজনকে কতই না মমতার সঙ্গে আগলে রেখেছেন। দায়িত্ব নিয়ে সবার দেখাশুনা করছেন। অথচ আমার দায়িত্ব ছিলো আপনার দেখাশুনা করা। হায় আমি সে দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। আমি মহান আল্লাহর দরবারে মাথা অবনত করছি যিনি আমাকে শাহাদতের জন্য মনোনীত করেছেন। আমার চেহারায় স্বতঃস্ফূর্ত হাসি মেখে আমি বিদায় নিচ্ছি। আমার সন্তান ও তাদের অনাগত সন্তানদের জন্য অনুসৃত একটি পথ রেখে যাচ্ছি। যাতে তারা সে পথের পথিক হতে পারে গর্ব ও নিষ্ঠার সঙ্গে। আল্লাহ তাআলা যেন আমার আকাংখা পূরণ করেন।
আফসোস হচ্ছে, পরিতাপ হচ্ছে, আমার জীবন সঙ্গীনীর জীবন আমি নিষ্কন্টক আনন্দময় করতে পারিনি। আল্লাহ তায়ালা যেন সব সময় তার সাহায্যকারী থাকেন।
বিস্ময়কর মনে হতে পারে, ভবিষ্যতের কোন কোন বিষয় পূর্বেই তার সরল ছায়া বিস্তার করে থাকে।
ইতি–
আপনার স্নেহের ছোট ভাই
হক নেওয়াজ কিয়ানী
ছেলে ও ভাইয়ের কাছে কর্নেল কিয়ানীর চিঠিতে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে, তিনি তার শাহাদাত বরণের ইংগিত পবিত্র কুরআনের বরকতে পূর্বেই পেয়েছিলেন। তার মায়ের কাছে চিঠিতে অনেকটা সংযত ভাষা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ভাইও ছেলেকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি তাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন। তাদের কাছে ইংরেজীতে লেখার সম্ভবত কারণ এটাই ছিলো। যাতে তার মা টের না পান তার ছেলে শহীদ হচ্ছেন।
কর্নেল কিয়ানীর জোয়ানরা মেজর সাবের খান ও মেজর ইয়ার আফজাল আফরিদীর নেতৃত্বে পাহাড়ের ওপর কিভাবে চড়েছিলো সেটা বেশ দীর্ঘ কাহিনী। এত বড় কাহিনী এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়।
প্রায় হাজার ফিট উচ্চতা অতিক্রম করার পর জানা গেলো স্কাউটের আশিজন জোয়ান কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সম্ভবত: ওব্রা পথ হারিয়ে ফেলেছিলো। রাতের আঁধার ও পাহাড়ের অজানা গিরি করে পথ হারা না স্বাভাবিক ব্যপার।
আযাদ কাশ্মীরের এই স্বল্প সংখ্যক সেনার মধ্যে এই আশিজন জোয়ান ছিলো বাহিনীর এক-তৃতীয় অংশ। কর্নেল কিয়ানী তখন অন্য পাহাড়ে অবস্থান করছেন। ওয়ারলেসে যখন তাকে এঘটনা জানানো হলো, তিনি মোটেও বিচলিত হলেন না। যোদ্ধার সংখ্যা তো এমনিতেই হাতে গোনা। তারপর এক তৃতীয়াংশ যোদ্ধা পাত্তা, এ অবস্থায় যত বড় দুর্ধর্ষ জেনারেল বা কর্নেল হোক না কেন, হামলা মুলতুবীর নির্দেশ দিতেন। কিন্তু কর্নেল কিয়ানী দুর্ঘর্ষেরও দুর্ধর্ষ। তিনি নির্দেশ দিলেন, পাহাড় চড়াই অব্যাহত রাখো। আল্লাহ তাআলা তোমাদের সঙ্গে আছেন হামলা মুলতুবী হবেনা।