আয়মান! সরদারকে তুমি বাড়ি নিয়ে যাও। তুমিও দুতিন দিন বিশ্রাম নিয়ে। সরকারের প্রতিও খেয়াল রেখো। ওর যখম মারাত্মকই বলা যায়। তবে ওর শরীর বেশ শক্ত। দেখছো না একটা চুলেও পাক ধরেনি! তাই আশা করা যায়, ওর যখম তাড়াতাড়িই শুকিয়ে যাবে। যখম শুকিয়ে গেলেও হপ্তাখানেক বিশ্রামে যেন থাকে।
আকি কাল বাদে পরশুও সুস্থ হয়ে যাবো। সরদারের দুর্বল কণ্ঠেও জযবার উত্তাপ টের পাওয়া গেলো। আমাকে নিয়ে ভেবো না কমান্ডার! স্পেনিশরা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি সতর্ক হয়ে গেছে। এটা শুধু মনে রেখো।
চমৎকার, চমৎকার সরদার! আবদুল করীম খুশি হয়ে বললো। তুমি পরশু কেন? আজই তো সুস্থ হয়ে গেছে। তবে সেটা মানসিকভাবে। দৈহিকভাবে সুস্থ হতে হপ্তা দেড়েকের কম লাগবে না। তাই ততদিন নিজের আবেগ-জ্যবাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।… আব্দুল করীম তারপর হুজ্জুল আয়মানের দিকে ফিরে বললো, আয়মান! আর দেরি করো না। সরদারকে বাড়ি নিয়ে যাও।
***
কি করে বাবার এ অবস্থা হলো? জুমানা তার বাবার মাথায় এত বড় ব্যাণ্ডেজ বাধা দেখে প্রায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যখম বেশি গুরুতর নয়। হপ্তাখানেকের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। আয়মান নিচু স্বরে বললো জুমানাকে।
কারণ সাজিদ সারহীকে বিছানায় শোয়ানো মাত্রই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। এটা ঔষধের প্রতিক্রিয়া।
জুমানা তাকে আবারো জিজ্ঞেস করলো, তার বাবার এ অবস্থা কি করে হয়েছে? আয়মান সংক্ষেপে জানালো, গেরিলা হামলা ও সেখানে সরদারের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। ডাক্তার কি বলেছে, কি ঔষধ দিয়েছে এবং আবদুল করীম কী বলে দিয়েছেন সেসব কথাও বললো আয়মান। শুধু বাদ দিলো, সে যে নিজের একক প্রচেষ্টায় সরদারকে বাঁচিয়েছে সে প্রসঙ্গ।
জুমানা আরো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। চোখমুখ ফুলে গেছে। উজ্জ্বল লাল আভা পুরো চেহারায় ছড়িয়ে পড়েছে। এতে তার মুখের স্বর্গীয় রূপ আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। রূপের এমন নিষ্পাপ বৈচিত্র আয়মান মনে হয় আর কোন দিন দেখেনি। তার মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো।
একবার তার কাছে মনে হলো, কারো সৌন্দর্যে এভাবে মুগ্ধ হলো প্রশংসাসূচক দুএকটা বাক্য তাকে বলতে হয়। পরক্ষণেই মনে হলো, এতো ইউরোপীয়ান রীতি। তার বাড়ি পশ্চিম জার্মানিতে। জার্মানিদের মধ্যে এ রীতির প্রচলন আছে। সে তো এখন মুসলমান। এ সুন্দরী অপ্সরীও একজন মুসলমান। তাকে কি বলা যায়? কিংবা আদৌ কিছু বলা উচিত কি না ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছিলো না আয়মান। জুমানা তখনো তার বাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার ফোলা চোখ দুটো ছলছলে।
আয়মানের তখনই মনে পড়লো, আরে তাকে তো এ ব্যাপারে পরিস্কার একটা শিক্ষা দেয়া হয়েছে। সেটা চমৎকার এবং সবচেয়ে নিরাপদ সামাজিক রীতি। এর মধ্যে দারূণ মানষিক আবেদনও আছে। আছে শালীন-সভ্য আদর্শ।
সেটা হলো, কোন নারীর দিকে ইচ্ছে করে তাকাতে নেই। এমনকি নির্দোষ দৃষ্টিতে তাকাতে নেই। আর কাম-দৃষ্টিতে তাকানো তো সরাসরি পাপ। অসভ্যতাও। ইসলাম এক শালীনতা বিবর্জিত একটা অপরাধ বলে গণ্য করেছে। কোন নারীর দিকে চোখ পড়লে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া উচিত। দ্বিতীয়বার আর তাকানো উচিত নয়। প্রথমবার যে অনিচ্ছায় বা কোন বিশেষ প্রয়োজনে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে এটা দোষণীয় কাজ হিসাবে গণ্য হবে না। এজন্য পাপও হবে না। তবে দ্বিতীয়বার দৃষ্টিপাত করাটা দোষণীয় এবং এজন্য পাপও লেখা হবে।
হুজ্জুল আয়মানের একথাটা মনে পড়তেই তার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। সে সঙ্গে সঙ্গে জুমানার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো।
এখন রাতের শেষ প্রহর চলছে। ভোর হতে আর বেশি সময় বাকি নেই। সরদার অঘোরে ঘুমুচ্ছে। মুখেও যন্ত্রণার ছাপ নেই। এর অর্থ হলো, ঔষধ বেশ ভালো কাজ করেছে। এখন আর এখানে না থাকলেও চলবে। ডাক্তারের কথামতো সরদারের ঘুম দুপুরের আগে ভাঙ্গবে না।
ইয়ে… শুনুন! আয়মান ইতস্তত করে বললো জুমানাকে এবং অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে, আপনি গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমি উনার পাশে বসছি। এখন আর উনি ঘুম থেকে উঠবেন না।
জুমানার চোখ এড়লো না, আয়মান তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। আয়মান ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মেদহীন শরীর। ছয় ফিটের মতো লম্বা। বয়স কত হবে? ত্রিশ বত্রিশ। তার বাবার সামনে যখন দাঁড়িয়ে ছিলো আয়মান, তখনই জুমানা লক্ষ্য করেছে, একে নিঃসন্দেহে সুঠামদেহী সুপুরুষ বলা যায়। ইউরোপীয়ান হলেও দেহবর্ণ এতটা শ্বেতকায় নয় যে, চোখে রাগে। এর মধ্যে বাদামী বর্ণের ছোঁয়া আছে।
আয়মান যে জুমানার প্রতি সশ্রদ্ধ-সমপূর্ণ পরিবেশ রক্ষা করে ওভাবে দৃষ্টি আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে, এটা জুমানার কাছে ভালো লাগলো। তার মনের অজান্তেই কৃতজ্ঞতার একটা ধারা তাকে নাড়া দিয়ে গেলো। এই প্রথম তার মনে হলো, এ লোকটির প্রতিই এত দিন জুমানা এক ধরনের তাচ্ছিল্যের মনোভাব পোশণ করে রেখেছিলো। এটা মনে হয়, ঠিক ছিলো না। বেশি সময় এভাবে নিরুত্তর থাকাও যে ঠিক নয় এটাও তাকে তাড়া করলো। তাই খুব নরম গলায় বললো,
ইয়ে… আয়মান সাহেব! বরং আপনি গিয়ে শুয়ে পড় ন। আমি তো এতক্ষণ ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। আমার ঘুম প্রায় হয়ে গেছে। আপনি তো বড় ক্লান্ত। রাতভর লড়াই করেছেন। তারপর এমন যখমী একটা মানুষকে এতদুর বয়ে নিয়ে এসেছেন। ধকল তো কময় যায়নি। ফজর হতে এখনো বেশ সময় বাকি। এতটুকু সময় বিশ্রাম করুন গিয়ে। ততক্ষণ আমি এখানে বসে থাকি।