ঠিক আছে বাবা! তুমি যা বলেছে সবই ঠিক। তোমার সেই হুজ্জুল আয়মান সাহেবও ভালো মানুষ। তাকে আমি খাঁটি মুসলমান হিসেবে মেনে নিচ্ছি। তবে তাকে বুকে তুলে নিতে পারবো না। সে তোমার বুকেই থাক। একথা বলে ফিক করে হেসে ফেললো জুমানা। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
সাজিদ সারহী দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটি তার বেশ জেদি হয়েছে। তবে ওর সুন্দর একটা মনও আছে। ইসলামের প্রতিও তার দায়বোধ আছে। কিন্তু আয়মানের প্রতি যে কেন এমন বিরূপ মনোভাব সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না সাজিদ সারহী।
এর দুদিন পর রাতে এক স্পেনিশ চৌকিতে গেরিলা হামলার কথা। গেরিলা দলে সাজিদ সারহী ও হুজ্জুল আয়মানও নাম লিখিয়েছে। গভীর রাতে দলটি স্পেনিশ চৌকিতে আক্রমণ চালালো। চৌকিতে শতিনেক আর্মি ছিলো। চৌকির চারপাশে অনেক দূর পর্যন্ত কড়া প্রহরা বসিয়ে রেখেছিলো স্পেনিশরা। গেরিলা দলে স্পেনিশ চৌকির অনেক দূর থেকেই অতি নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে থাকে। এ কারণে প্রহরায় থাকা স্পেনিশ আর্মিরা টের পায়নি কিছুই।
টের পায় তখনই যখন পেছন থেকে ছোরা বা খঞ্জরবিদ্ধ হয়ে ছটফট করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। কিন্তু এরপর তো আর কিছুই করার কথা নয়। এভাবে একে একে সতের জন আর্মি প্রহরীকে নিঃশব্দে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে চৌকিতে হামলা চালায় গেরিলারা।
ভেতরের স্পেনিশ সেনারা তো জানে বাইরে নিশ্চিদ্র প্রহরার ব্যবস্থা আছে। কোন চিন্তা নেই। কিছু ঘটলে প্রহরীদের কাছ থেকে আগাম সংবাদ পেয়ে প্রস্তুত হয়ে যেতে পারবে। সেই ভেবে তারা নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছিলো। তাই ঘুমের তিনভাগের এক ভাগ সৈন্য খতম হয়ে যায়। যারা ঘুম থেকে জাগতে পারলো তারা চরম আতঙ্ক ও ভয়ে দিশেহারা হয়ে গেলো। অনেকে সামলে উঠে লড়তে চেষ্টা করলো। কেউ কেউ আবার পালাতে চেষ্টা করলো।
পালাতে গিয়েও কিছু মারা পড়লো। যারা লড়তে চেষ্টা করলো, তারা এলোপাথারি গুলি ছুড়ছিলো। তাই তাদের গুলির টার্গেট নিজেদের লোকরাই হতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে অধিকাংশ স্পেনিশ আর্মিই নিজেদের প্রাণ নিয়ে পালাতে লাগলো।
হুজ্জুল আয়মান অর্থাৎ সার্জেন্ট ক্লাইমাস পলায়নরত এক স্পেনিশ অফিসারকে মাত্র যমের বাড়ি পাঠিয়েছে, অমনি তার কানে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠের এক চিৎকার। আওয়াজটা এসেছে ডান দিক থেকে। সেদিকে তাকিয়ে দেখলো, ত্রিশ পঁয়ত্রিশ গজ দূরে একটা তাবুর পেছন দিকে সাজিদ সারহীকে দুই স্পেনিশ ধরে রাইফেলের বাট দিয়ে মারছে।
আয়মান মুহূর্তের মদ্যে সেখানে পৌঁছে গেলো। গুলি না চালিয়ে একজনকে সজোরে কোমরে লাথি মারলো। লাথি খেয়ে ঘোত করে পড়ে গেলো সৈন্যটি। সঙ্গে সঙ্গে পাশের জনকেও একই কায়দায় লাথি চালালে। রাইফেল ফেলে সেও পড়ে গেলো। মাটিতে পড়েই দুই চিত্তার জুড়ে দিলো, ক্লামাসকে পাওয়া গেছে। ক্লাইমাসকে পাওয়া গেছে।
স্পেনিশরা ক্লাইমাস ফেরার হয়ে যাওয়ার পর তাকে জীবিত ধরতে অনেক চেষ্টা করে। তারপর ঘোষণা দেয়, যে তাকে জীবিত বা মৃত ধরতে পারবে, তাকে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে।
এ কারণেই দুই স্পেনিশ মৃত্যুর মুখে পড়েও যখন ক্লাইমাসকে চিনতে পারলো, তখন দশ লক্ষ টাকার লোভ দুজনের মৃত্যুভয় দূর করে দিলো। তারা ক্লাইমাস বলে চিৎকার করতে লাগলো। অন্যান্য স্পেনিশ আর্মিরা তো যে যেভাবে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। কারো দিকে কারো কোন খেয়াল নেই। তবে দুজনের চিৎকার শুনে একজনকে দৌড়ে এদিকে আসতে দেখা গেলো। সঙ্গে সঙ্গে তার বুক লক্ষ করে গুলি চালালে ক্লাইমাস ওরফে আয়মান। দেরি না করে পড়ে থাকা দুজনকেও চিরদিনের জন্য চুপ করিয়ে দিলো।
তারপর রাইফেল রিলোড করে ককেয় মিনিট অপেক্ষা করলো কেউ এ দিকে আসে কি না। না, আর কেউ এলো না। তারপর মনোযোগ দিলো সাজিদ সারহীর দিকে। আর সাজিদ পড়ে আছে নিস্তেজ হয়ে। তার মাথা ও মুখ রক্তাক্ত। রাইফেল দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়েছে।
আয়মান ডাকলে তাকে সরদার…. সরদার! কি অবস্থা তোমার?
পানি… পানি.. আমার মেয়ে, জুমানা… তারপর তার কথা বন্ধ হয়ে গেলো।
আয়মান দ্রুত নাড়ি পরীক্ষা করলো। নাড়ি চলছে। অজ্ঞান হয়ে গেছে। মশালের আবছা আলোয় সব দেখা যাচ্ছে। স্পেনিশ এই ক্যাম্পটি এখন মুক্তিসেনাদের গেরিলা ইউনিটের দখলে। জীবিত কোন স্পেনিশ আর্মিকে দেখা যাচ্ছে না। অগণিত স্পেনিশ আর্মির লাভ চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। কিছু আহত আর্মি গোঙাচ্ছে, কাতরাচ্ছে। গেরিলারা আহতদের উঠিয়ে নিচ্ছে। নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে এদেরকে সুস্থ করে তোলা হবে যুদ্ধবন্দি হিসাবে।
আয়মান এক গেরিলাকে ডেকে আনলো। দুজনে মিলে সাজিদ সারহীকে উঠিয়ে নিলো।
ক্যাম্পে এনে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর সাজিদ সারহীর জ্ঞান ফিরে এলো। মাথার ডান দিকে কানের নিচে আঘাত করা হয়েছে। সে জায়গাটা প্রায় থেতলে গেছে। সেখান দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত ঝরছিলো। শল্য চিকিৎসক এক ধরনের পাউডার দিয়ে রক্ত ঝড়া বন্ধ করে দিলো। মুখেও ঔষধ দিলো। তারপর মধুযুক্ত দুধ পান করানো হলো। এতে সরদারের ফ্যাকাশে চেহারায় কিছুটা প্রাণ ফিরে এলো। সেখানে আবদুল করীমও ছিলো। আবদুল করীম হুজ্জুল আয়মানকে বললো,