এখন দিনের বেলায় হুজ্জুল আয়মান ক্যাম্পে চলে আসে। কাজ শেষ করে বিকালে বা সন্ধ্যায় সরদার সারহীর বাড়িয়ে চলে যায়।
সাজিদ সারহীর একটি মাত্র মেয়ে সন্তান। জুমানা সারহী। অপরূপ সুন্দরী। নিজেদের মাতৃভাষা টুকটাক ইংরেজি, ফ্রান্স ও স্পেনিশ ভাষাও বুঝে। বলতেও পারে। তো জুমানা সাহরী বেঁকে বসলো। সে তার বাবা সাজিদ সারহীকে বললো,
বাবা! তুমি কিভাবে এক ইউরোপিয়ানকে ধরে নিয়ে এলে?
আহ মা! সাজিদ বললো, আস্তে কথা বলল।
এখান থেকে চিৎকার করে কথা বললেও ওই সাদা চামড়া আমার কথা শুনতে পাবে না। কারণ, সে এখন এখানে নেই। তোমাদের ক্যাম্পে ফিরে গেছে।
এই ছেলে তো এখন শুধু ইউরোপীয়ান নয়, সে মুসলমান হয়ে গেছে। সে স্পেনিশ আর্মির সার্জেন্ট ছিলো। আমাদের কমাণ্ডার আবদুল করীমের আদর্শ তাকে মুগ্ধ করে। এজন্য সে এখানে এসে মুসলমান হয়ে যায়।
কোন খাঁটি মুসলমানকে এভাবে স্থায়ী মেহমান হিসেবে আনতে পারলে না?
সেই ছেলে হুজ্জুল আয়মান শুধু খাঁটি মুসলমান না, আমাদের চেয়ে ভালো মুসলমান।
ছাই মুসলমান! আমরা জন্ম থেকে মুসলমান হয়েও খাঁটি মুসলমান হতে পারলাম না। আর সে দুদিনেই খাঁটি মুসলমান হয়ে গেলো! শোন বাবা! তোমার মনে রাখা দরকার, এ শোক খ্রিষ্টান ছিলো। এরা মুসলমানের চিরশত্রু। মুসলমানদের জন্য এরা বিষধ সাপের চেয়ে ভয়ংকর। সাপকে দুধ কলা দিয়ে পুষলেও সে সুযোগ পেলেই ছোবল মারে, দংশন করে। এই লোকও দেখবে এক সময় তার ফণা তুলে তোমাদেরকে ছোবল মারছে।
মানুষ আর সাপ কি এক মা! সাজিদ সারহী খুব নরম গলায় বললো, সাপের জন্মই হয় হিংস্রতা নিয়ে। আর মানুষ কল্যাণ ও শুভবার্তা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তারপর মা-বাবা, পরিবার বা প্রতিবেশী কিংবা পরিবেশের কারণে সে মুসলমান, ইহুদী, খ্রিষ্টান বা অন্য কোন ধর্মালম্বী হয়। কেউ জন্ম থেকে মুসলমান হলেই খাঁটি মুসলমান হতে পারে না, তার ঈমান ও কর্মকাণ্ড ঠিক না করলে। দেকা যায় একজন মুসলমান সারা জীবন তার ঈমান আমল ঠিক না করার কারণে পূর্ণাঙ্গ মুসলমান হতে পারে না। আবার একজন ঘার নাস্তিক বিশুদ্ধ ঈমান-বিশ্বাস নিয়ে মুসলমান হয়ে সঠিক নিয়মে ইবাদত-বন্দেগী করে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে খাঁটি মুসলমান হয়ে যেতে পারে অল্প সময়েই। মুসলমান বা খাঁটি মুসলমান হওয়া পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত কোন বিষয় নয়। এটা কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। যেটা অধিকাংশ মুসলমানই অর্জন করতে পারে না। এ কারণেই আজ দুনিয়ায় সত্যিকার মুসলমানের সংখ্যা কমে গেছে।
দেখো না মারাকেশ সেই কবে দখলদাররা দখল করে নিয়েছে। কোন মুসলমান কি এতদিন এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে? মুসলমানরা শুধু মারই খেয়েছে। যেন মার খাওয়াই মুসলমানদের কাজ! মুসলি নারীদের সম্ভ্রম লুটতে দেয়াই আমাদের দায়িত্ব? এটা সম্ভব হয়েছে মুসলমানদের ঈমান অতি দুর্বল হওয়ার কারণে। আজ মুসলমানরা সবখান থেকে বিতাড়িত হচ্ছে। ঈমান দুর্বল হওয়াতে এক মুসলমান আরেক মুসলমানের প্রতি কোন দায়বোধ করে না। কোন সহমর্মিতা পোষণ করে না। বিশ্বাস ও ভরসা রাখে না। এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে প্রতিপক্ষ মনে করে। যেমন তুমি এই বেচারা আয়মানকে সহ্য করতে পারছে না।
দেখো বাবা! তুমি আমার ঈমান দুর্বল বলতে পারো। আমল মন্দ বলতে পারো এবং আমাদের ঈমান যে খুব শক্তিশারী না তাও আমি স্বীকার করবো। কিন্তু একজন মুসলমানকে সহ্য করতে পারছি না একথা তুমি বলতে পারো না। আমি এত খারাপ মেয়ে নই। ওই লোককে তো সামনাসামনি দেখিইনি। দূর থেকে দেখেছি। তাও অনিচ্ছাকৃত। একজন মেয়ে হিসেবে তাকে দেখলে আমার মনে হয় যে কেউ পছন্দ করবে। কিন্তু কোন ইউরোপীয়ান দেখলে আমার মনে পড়ে যায়, মুসলমানদের প্রতি তাদের হিংস্র আচরণের কথা। তাই তুমি যত কথাই বলো মুসলমান হিসাবে তাকে আমার এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। জুমানা সারহী বললো।
দেখো জুমানা! আমাদের কমান্ডার আবদুল করীম কী বলেছে জানো? সে সবসময়ই একথা বলে যে, এক মুসলমানের প্রতি আরেক মুসলমানের যদি ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে, তাহলেই মুসলমানরা আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। আর এ সম্পর্ক গড়ে উঠবে একমাত্র ঈমান ও আমলের সূত্র ধরে। যখন মুসলমানদের মধ্যে এ জিনিসটা ছিলো, তখন মুসলমানরা বিশ্ব শাসন করেছে।
হাজার হাজার মাইল দূরের সেই ভারতের সিন্ধু থেকে এক অসহায় নারী চিঠি পাঠিয়েছিলো হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে। সেই মাজলুমা নারীর ডাক শুনে মুহাম্মাদ ইবনে কাসেম ছুটে এসেছিলেন ভারত বর্ষে। তারপর ভারতবর্ষ অর্থাৎ পুরো উপমহাদেশ জয় করেন। শুধু কি তলোয়ারের জোরে। অধিকাংশ বিজয়ই অর্জন করেছিলেন বিনা রক্তপাতে। লক্ষ লক্ষ হিন্দু তখন ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। মুহাম্মাদ ইবনে কাসেম যদি তাদেরকে হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়ার কারণে দূরে সরিয়ে দিতেন, বুকে তুলে না নিতেন, তাহলে কি অবস্থা হতো বিশ্ব মুসলিমের? তাই জুমানা! বুঝতে চেষ্টা করো। ইহুদী-খ্রিষ্টানরা আমাদের শত্রু ঠিক; কিন্তু তারা মুসলমান হয়ে গেলে আমাদের বন্ধু হয়ে গেলো।
***
সরদার সাজিদ সারহী এমনিতে বেশ আবেগী মানুষ। তবে একসময় ধর্মকর্মের খুব একটা মনোযোগী ছিলো না। আবদুল করীমের সান্নিধ্যে এসে তার জীবন আমূল পাল্টে যায়। এই চেতনা সে তার গোত্রের মধ্যে বিপ্লব আকারে ছড়িয়ে দেয়। এজন্য তার সঙ্গে তার গোত্রের লোকেরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিসেনায় যোগ দেয়। তবে আজ সাজিদ সারহীকে যেন কথায় পেয়েছে। তার মেয়ে জুমানা এটা বুঝতে পারলো। তাই তার বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,