এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে এ কারণেই হয়তো গড আমার বিবেককে জাগিয়ে দিয়েছেন। তোমরা কি কারণে মালীলা থেকে অবরোধ উঠিয়েছে সেটা শোনার পরই আমি আমাদের ধর্ম থেকে ফেরার হয়ে গেলাম। বহু কষ্ট করে অনেক অনুমান করে বের করেছি তোমাদের এ এলাকায় ক্যাম্প রয়েছে। আমি পায়ে হেঁটে এ পর্যন্ত পৌঁছেছি। এত মাইলের পর মাইল দুর্গম পথ কিভাবে যে পাড়ি দিয়েছি তা জানি না। শুধু এতটুকু জানি, বিবেকের দংশনে কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
পাপের বিশাল এক পাহাড় আমার ওপর চেপে বসেছে। আমি সেটা নামাজে এসেছি। আমাকে সেই আলো দেখাও, যা আত্মজগতকে আলোকিত করে। যে আলো আমার ভেতরের অন্ধকারকে দূর করে দেবে। আর যদি আমাকে গুপ্তচর মনে করে মৃত্যুদণ্ড দিতে চাও, তবে আগে আমাকে মুসলমান বানিয়ে নিয়ে। যাতে আমি খোদার কাছে এমন পবিত্র মানুষ হয়ে পৌঁছতে পারি, যে তার সব পাপ থেকে তাওবা করে ধুয়ে মুখে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
তার কথাগুলো দারুণ হৃদয় ছোঁয়া ছিলো। সেখানে আবদুল করীমের সঙ্গে যে কমান্ডাররা ছিলো তাদের মনে কথাগুলো ভীষণ দাপ কাটলো। তবে আবদুল করীমের মতো এমন তীক্ষ্ম দৃষ্টির এক কমান্ডার তার কথায় বেশ প্রভাবান্বিত হলেও সহসাই এ ফায়সালা করতে পারছিলো না যে, স্পেনীয় আর্মির এই সার্জেন্ট কোন গুপ্তচর নয়। বিচক্ষণ-দূরদর্শী কোন কমাণ্ডারের পক্ষে হঠাৎ করে কারো ব্যাপারে এমন নিশ্চিত ফায়সালায় পৌঁছা সম্ভব নয়। তাই আব্দুল করীম অনেকটা নির্বিকার কণ্ঠে বললো,
দেখো সার্জেন্ট! তুমি যা কিছু বলেছে, তা সত্য না মিথ্যা সেটা আল্লাহই ভালো জানেন। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আশা কর আমরা কোন ইঙ্গিত পেয়ে যাবো তোমার আসল পরিচয় সম্পর্কে। এখন আমরা যা করতে পারি তা হলো, তোমার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করে দিতে পারি। তুমি এখন আমাদের নজরবন্দি অবস্থায় থাকবে।
তারপর আবদুল করীম নিজের সঙ্গেই রাখলো সার্জেন্ট ক্লাইমাসকে। কারণ সে গুপ্তচর না হলে তার কাছ থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়ার ছিলো। সে ক্ষেত্রে সে নিজেও কম মূল্যবান নয়। সে যেখানেই যেতো, যাই করতো তার ওপর সবসময় বার জোড় চোখ কঠিন দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতো। সেটা এমন সন্তর্পণে যে, যে ছয়জন ছাড়া মুক্তিসেনাদের অনেক কমাণ্ডারও এ ব্যাপারে কিছু জানতো না।
অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই এটা প্রমাণিত হয়ে গেলো যে, সার্জেন্ট ক্লাইমাস কোনো গুপ্তচর নয়।
ক্লাইমাস স্পেনিশ ও ফ্রান্সীয়দের ব্যাপারে অনেক অজানা তথ্য দেয়। তাদের সেনাবিন্যাস ও বিভিন্ন গুপ্ত স্কোয়াডের ব্যাপারে অভাবনীয় অনেক বিষয় আ তার কাছ থেকে জানা যায়। আবদুল করীমের মনে হলো, আল্লাহ তাআলা তাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কারণ, এসব বিষয় কখনোই মুসলিম মুক্তিসেনারা জানতে পারতো না। এখন রণাঙ্গনের অনেক ক্ষেত্রে তড়িং ফায়সালা করাটা আবদুল করীমের জন্য সহজ হয়ে গেলো।
তারপর ক্লাইমাস গুপ্তচরবৃত্তির ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বও নিয়ে নেয় স্বেচ্ছায়। বেশ কয়েকটি নৈশ হামলায় দারুণ বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্ব দেখায়। ব্যক্তি হিসেবে ক্লাইমা খুব অমায়িক ও সদালাপী। মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকে। এজন্য অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ক্যাম্পের সবার কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। একদিন সে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয় এবং সবার সামনে মুসলমান হয়ে যায়। আবদুল করীম তার নাম রেখে দেয় হুজ্জুল আয়মান।
***
ইতিমধ্যে মারাকেশের মরু এলাকার কিছু মরুচারী গোত্র সরদার ও আবদুল করীমের মুক্তিসেনা দলে যোগ দেয়। এদের মধ্যে এক সরদার তো তার পুরো গোত্র ও পরিবারসহ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। এই সরদারের নাম সাজিদ পারহী। সাজিদ পারহীও বেশ সদালাপী মানুষ। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে হুজ্জুল আয়মানের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠে।
হুজ্জুল আয়মান (সার্জেন্ট ক্লাইমাস) দেখতে বেশ সুদর্শন ছিলো। ইসলাম গ্রহণের পর সে খুব নিষ্ঠাবান মুসলমান হয়ে যায়। অন্যান্য মুসলমানের চেয়ে তাকে ইসলামী বিধি-বিধান পালনে বেশ যত্নবান দেখা যায়।
এই মাস দুয়েকের মধ্যে তার দাঁড়িও বেশ ঘন হয়ে উঠেছে। আগেই আয়মানকে বেশ সুদর্শন লাগতো। এখন ঘন চাপদাড়িতে আরো সুদর্শন লাগে।
গোত্র সরদার সাজিদ সারহীর কাছে হুজ্জুল আয়মানকে এতই ভালো লেগে গেলো যে, তাকে তার বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেলো। মুক্তি সেনাদের হেডকোয়ার্টার থেকে তার বাড়ি মাইল খানেক দূরে। সাজিদ সারহী আবদুল করীমকে একদিন বললো,
ভাই আবদুল করীম! তোমাদের এই নওমুসলিম হুজ্জুল আয়মানকে আমার বেশ ভালো লেগেছে। আমি চাই ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে অতিথি হিসেবে রাখতে। ও আমাদের চেয়েও পাক্কা মুসলমান হয়ে উঠছে। ওর মতো একজন মানুষের সেবা করতে পারাও ভাগ্যের ব্যাপার।
এতো খুব ভালো প্রস্তাব! তোমার এ কথায় আমার ইসলামের প্রথম যুগের আনসার সাহাবীদের কথা মনে পড়ে গেলো। আনসার সাহাবীরা এভাবে মুজাহিরদের ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করে নিয়েছিলেন। তবে হুজ্জুল আয়মান স্বতস্ফূর্তভাবে তোমার মেহমানদারি গ্রহণ করে কিনা সেটাও যাচাই করে নিয়ে। আবদুল করীম বললো।
সাজিদ সারহীর প্রস্তাবে হুজ্জুল আয়মানে প্রথমে তার বাড়িতে এভাবে যেতে মৃদু আপত্তি করলেও আবদুল করীমের কথায় তার সে আপত্তিও কেটে গেলো।