ওরা সার্জেন্টের কথা বিশ্বাস করলো না। একজন তো বলেই ফেললো,
ওই বেটা! সাদা চামড়া। আর চাপা মেরো না। তোমরা ইউরোপীয়ানরা মিখা ছাড়া কথাই বলতে পারো না। তোমরা তো এদেশে এসেছিলে মারাকেশের নিরাপ চুক্তির অধীনে। এর অর্থ তো ছিলো আমাদের মারাকেশের মুসলমানদের জীবন হবে শান্তি-সুখের। কিন্তু তোমরা আমাদেরকে জাহান্নামের কীট বানিয়ে ছেড়েছে। আমাদের দেশ দখল করে নিয়েছে। ঘর-বাড়ি, টাকা-পয়সা, সুখ-শান্তি সব ছিনি। নিয়েছে। এখন দেখো তোমাকে আমরা কি করে জাহান্নামের কীট বানাই।
মুক্তিসেনাদের নিয়ম ছিলো, তাদের এলাকায় কোন গাদ্দার বা গুপ্তচর ধরা পড়লে তাকে জীবন্তু মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হবে। এজন্য তারা উপরস্থ কমান্ডারের কাছ থেকে অনুমতি নেয়ার প্রয়োজনও বোধ করতো না। সে নিয়ম অনুযায়ী তারা ক্যাম্পের কাছাকাছি একটা জায়গায় বড় করে গর্ত খুঁড়লো। এই গর্তের মধ্যে একজন মানুষকে সহজেই দাফন করা যাবে।
ঘটনাক্রমে সেখানে আবদুল করীমের নিকটস্থ এক কমান্ডার কোন এক কাজে সেখান দিয়ে যাচ্ছিলো। গর্ত খুঁড়তে দেখে সৈনিকদের কাছে ঘটনা জানতে চাইলো কমাণ্ডার। তাকে জানানো হলো, স্পেনিশ আর্মির এই গুপ্তচরের জন্য গর্ত খোঁড়া হচ্ছে। কমাণ্ডার সার্জেন্ট ক্লাইমাসের বক্তব্য শুনলো। ক্লাইমাস সৈনিকদের যে কথা বলেছিলো তাকেও একই কথা বললো।
কমাণ্ডার তার কথা শুনে অনুভব করলো, তাকে আবদুল করীমের কাছে একবার নিয়ে যাওয়া উচিত। সে আসলেই গুপ্তচর হলে সেখানেও তাকে শাস্তি দেয়া যাবে। তা ছাড়া গুপ্তচর হলেও শক্ত জেরার মুখে মূল্যবান কোন তথ্যও তার কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারে।
তাকে আবদুল করীমের সামনে উপস্থিত করা হলো। আবদুল করীম তাকে জিজ্ঞেস করলো,
কে তুমি? এদিকে এসেছো কেন? জানো না, এখানে ধরা পড়লে গুপ্তচরের অভিযোগে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।
আমার নাম ক্লাইমাস। সার্জেন্ট বললো, স্পেনীয় আর্মিতে সার্জেন্ট পদে ছিলাম। সার্জেন্ট হলেও মেজর কর্ণেলদের সঙ্গে আমার উঠাবসা ছিলো। কিন্তু আমাদের আর্মির লোকেরা এখানকার মুসলমানদের ওপর যে জুলুম অত্যাচার করেছে এবং দিন দিন তা যেহারে বেড়ে চলেছে, ওদের এই অমানুষিক পৈশাচিক আচার-আচরণ আমার বিবেককে জাগিয়ে দিয়েছে। জীর্ণশীর্ণ মুসলমান বাচ্চাদেরকে স্পেনিশ অফিসারদের যেভাবে বেগার খাটাতে দেখেছি তা কোন পশুর পক্ষেও সম্ভব নয়। আট নয় বছরের ছেলে মেয়েদেরকে দিন রাত গাধার মতো খাঁটিয়ে এক বেলাও খাবার খেতে দেয় না ওরা।
কত বাচ্চাকে আমি না খেতে খেতে মরে যেতে দেখেছি।
নিষ্পাপ মেয়েদের ওপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে ক্ষতবিক্ষত করে গুলি করে মেরে ফেলে। যাকে ইচ্ছে তাকেই ওরা গুলি করে মেরে ফেলে। মুসলমানদেরকে ওরা মানুষই মনে করে না। ওদের যে হিংস্রতা ও পৈশাচিকতা আমি দেখেছি, তোমরা তা কল্পনাও করতে পারবে না। তোমরা বাইরে থেকে ওদের যে অমানুষিকতার কথা শোনা তা খুব সামান্যই শুনে থাকো।
আমার হাতেও অনেক হিংস্র কাজ করানো হয়েছে। গত কয়েক রাত থেকে আমি ঘুমুতেও পারছি না। ক্ষুধার যন্ত্রণার ও বর্বর-পিশাচদের অত্যাচারে যে শিশুগুলো চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাদের রক্তাক্ত মুখগুলো আমাকে ঘুমুতে দিচ্ছে না। আমার বিবেক আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। এত দিন পর আমার মৃত অনুভূতি-উপলব্ধি জেগে উঠেছে। আমাকে কুড়ে কুড়ে দংশন করছে। আমি এখন অনেকটা দিশেহারার মতো অবস্থায় পড়েছি। না হয় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এখানে আসার সাহস পেতাম না কখনো।
অবশেষে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, যে ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে মানুষের প্রতি দয়া, ভালোবাসা, সহমর্মিতা নেই সেটা কখনো সত্য ধর্ম হতে পারে না। আমাদের খ্রিষ্ট ধর্মে তো গড এর প্রতিও কাউকে বিশ্বাসী দেখা যায় না। তারা গীর্জা-চার্চ বানিয়ে রেখেছে মানুষকে দেখানোর জন্য। ওখানে কোন ইবাদত বা প্রকৃত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় না। যে পাদ্রীদের লোকেরা নিষ্পাপ বলে মনে করে তারা তো স্বার্থের সামান্য উপলক্ষ্যেই মিথ্যা বলে। মুসলমানদেরকে কি করে নাজেহাল করা যায়, কিকরে ধ্বংস করা যায়, তারা এ পরিকল্পনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। একেই তারা ইবাদত মনে করে। মুসলমানদের ব্যাপারে কেউ কোনো ভালো কথা বললে, তার মুখ চেপে ধরে। এভাবে পাদ্রী, যাযকরা খ্রিষ্টের অনুসারীদেরকে মিথ্যাবাদী ও প্রতারক হওয়ার শিক্ষা দান করেছে।
আমি শুনেছি তোমরা নাকি মালীলা থেকে এজন্য অবরোধ উঠিয়ে নিয়েছো যে, শহর জয় করার পর সেখানকার ইউরোপীয় অধিবাসীদেরকে তোমাদের মুক্তিসেনারা নির্বিচারে হত্যা করবে। যা তোমাদের ধর্মে পাপ বলে মনে করে। অথচ তোমরা তা করলে আমরা খুব আশ্চর্যান্বিত হতাম না। কারণ, আমরা ইউরোপীয়ানরা যখন ওখান থেকে তোমাদেরকে বের করে দিয়ে তোমাদের ঘর বাড়িগুলো দখল করে নিয়েছিলাম, তখন আমরাও এর চেয়ে নির্মম আচরণ করেছিলাম তোমাদের সঙ্গে। আমি যে বাড়িটিতে থাকতাম, সেটাও কোন মুসলমানের বাড়ি। বাড়িতে একটা পুরনো কুরআন শরীফ পেয়েছিলাম। একবার ভেবেছিলাম সেটা ফেলে দেবো কিনা। কিন্তু মন সায় দিলো না। সেটা যত্ম করে আমার আলমিরার ভেতর রেখে দিলাম।