আবদুল করীম একদিন মিলীলা নামক অনেক বড় একটি শহরের ওপর চড়াও হলো। শহরটি মারাকেশের অন্যতম কেন্দ্রীয় শহর। এখানে ফ্রান্স, স্পেনসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশের অভিজাত লোকেরা বসবাস করে। বিত্ত ও প্রাচুর্যের এমন প্রদর্শনী এ শহরের মতো অন্য শহরগুলোতে খুব একটা দে যায় না। শহরের জনসংখ্যা চল্লিশ হাজার। আবদুল করীম শহর অবরোধ করলো। পুরো শহর মুক্তিসেনারা ঘিরে নিলো।
মারাকেশের যারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে, তাদের অনেকেরই পূর্বপুরুষদের ভিটেবাড়ি ছিলো এই শহরে। এই মিলীলা শহরেই অনেকের শৈশব কেটেছে। ইউরোপীয়রা তাদেরকে তাদের ভিটেবাড়ি থেকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছে।
তাই স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিসেনাদের মধ্যে নষ্টালজিক ছড়িয়ে পড়লো। সেটা ক্রমেই রূপ নিলো ভয়াবহ প্রতিশোধ স্পৃহায়। এমনকি মুক্তিবাহিনীর মধ্যে এমন একটা দাবীও উঠলো, এই শহরে ইউরোপের যত লোক আছে তাদেরকে হত্যা করে তাদের অঢেল ধনসম্পদ সব নিয়ে নিতে হবে। যেগুলো মারাকেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কাজে লাগানো হবে।
আবদুল করীম মুক্তিসেনাদের এই মনোভাবের কথা শুনে সবাইকে ডেকে এনে খুব সংক্ষেপে বললেন,
আমাদের দৃষ্টি শুধু শহরের ওপর। শহরবাসীর ওপর নয়। এটা ঠিক যে এই নির্দয় বিধর্মীরা অনেক নিরপরাধ মুসলমানকে মশা মাছির মতো মেরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এবং হাজার হাজার নারীর সম লুটে নিয়েছে। এত কিছুর পরও আমি শহরবাসীর ওপর হাত উঠাবো না। এটা সত্যিকারের কোন মর্দে মুজাহিদ স্বাধীনতাকামী মুক্তিসেনার ব্যক্তিত্বের পরিপন্থী যে, সে কোন নিরস্ত্র মানুষের রক্ত ঝড়াবে। মনে রাখবে, ইসলাম মানবতার শিক্ষা দেয়, শিক্ষা দেয় মহানুভবতার। তোমাদের উদার-মহানুভব আচরণ হয়তো হিংস্রপ্রাণীর মতো ওই মানুষগুলোকে সত্যিকার মানুষে পরিণত করবে।
এ ধরণের বক্তব্য দেয়ার পরও মুক্তি সেনাদের আবেদ-উত্তেজনা এবং চাপা ক্রোধ ক্রমেই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো। এই প্রথম আবদুল করীম অনুভব করলো, তার হাতে গাড় এই দলটি তার কথা শুনতে চাচ্ছে না। ইউরোপীয়ানদের হত্যার দাবী এখনো তারা পরিত্যাগ করেনি।
আব্দুল করীম এতে খুব একটা বিচলিত হলো না। তাকে যে চিন্তাটা অস্থির করে তুললো। সেটা হলো, এই শহরে যুবতী মেয়েরাও রয়েছে। যা মুক্তিসেনাদের ঈমান-বিশ্বাসকে হালকা করে দিতে পারে। আর যে বৈভব আছে, তাতে তাদের এতদিনের লালিত বিশুদ্ধ সংকল্পে নাড়া দিয়ে যেতে পারে। নারী ও সম্পদের লোভ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যুদ্ধশক্তিকেও ভেতর থেকে ঘুণ পোকার মতো খেয়ে ফেলে।
আবদুল করিম দেখলো, শহর অবরোধ বেশ সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শহরের ওপর একযোগে হামলা চালালেই এখন শহর জয় সম্পন্ন হয়ে যাবে। শহরবাসীদের সাহায্যে স্পেনিশ সেনারাও আসবে না কিংবা সেই সাহসও নেই তাদের। তাই শহর বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু তারপর তো তার মুক্তিসেনারা শহরবাসীদের ওপর প্রতিশোধ নেবে। চরম প্রতিশোধ। বিজিত লোকদের ওপর প্রতিশোধের নেশায় চড়াও হওয়া ইসলাম কখনো সমর্থন করে না।
এসব সাত পাঁচ ভেবে আবদুল করীম অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিলো এবং অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে তার হেডকোয়ার্টারে ফিরে গেলো তার মুক্তিসেনাদের নিয়ে।
ইউরোপীয় ও অনেক বিধর্মী ঐতিহাসকিরা কেবল এই একটি ঘটনার ওপর ভিত্তি করে আবদুল করীমকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তারা অকপটে স্বীকার করেছেন, আবদুল করীম চারিত্রিক, মানবিক, আদর্শিক ও নৈতিক এবং চরম বিবেকবোধের প্রতি তার দারুণ ভীষণ মুগ্ধ।
***
তাই এই অসাধারণ আদর্শিক ব্যক্তিত্ববোধের প্রতি অনেক স্পেনিশ, ফ্রান্সীয় ও ইউরোপীয়ানরাও বিমুগ্ধ ছিলো। স্পেনিশ আর্মির এক সার্জেন্ট তো আবদুল করীমের নেতৃত্বগুণের প্রতি প্রভাবান্বিত হয়ে নিজের দল ত্যাগ করে। তার নাম সার্জেন্ট কালাইমাস।
সার্জেন্ট কালাইমাস। বয়স সাতাইশ থেকে ত্রিশের কোঠায় হবে। স্পেনিশ আর্মিতে বেশ সুনাম ছিলো ক্লাইমাসের। আর কিছু দিন পরই পদোন্নতি হয়ে গেলে কর্ণেল হয়ে যেতো। সার্জেন্ট ক্লাইমাস স্পেনিশ ছিলো না। ইউরোপের অন্য কোন দেশের লোক ছিলো।
একদিন লুকিয়ে হাপিয়ে সার্জেন্ট ক্লাইমাস স্পেনিশ হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে পড়লো। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সেই পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছে গেলো। এখানেই কোথায় রয়েছে আবদুল করীমের মুক্তিসেনাদের ক্যাম্প। মুক্তিসেনারা তাদের ক্যাম্প ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূরদুরান্ত পর্যন্ত সতর্ক প্রহরায় থাকতো। এতগুলো সতর্ক চোখ এড়িয়ে মশা মাছিও ক্যাম্প এলাকায় ঢুকতে পারতো না।
সার্জেন্ট ক্লাইমাসকে ভবঘুরের মতো একা একা ঘুরতে দেখে মুক্তিসেনারা তাকে পাকড়াও করলো। তার ওপর একমাত্র এই সন্দেহই করার ছিলো যে, সে স্পেনিশ আর্মির গুপ্তচর। মুক্তিসেনারাও তাকে গুপ্তচর হিসাবেই গ্রেফতার করলো। তবুও ক্লাইমাস বললো,
আমি আসলে তোমাদের জেনারেল আবদুল করীমের সঙ্গে সাক্ষত করতে এসেছি। জানি, তোমরা আমার একথা বিশ্বাস করবে না। আমাকে শক্রদলের চর মনে করছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি স্পেনিশ আর্মিল লোক ছিলাম। এখন আর নই। সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি। অবশ্য আমার বক্তব্যের পক্ষে কোন প্রমাণও নেই আমার কাছে।