চরম উদ্ধত-অহংকারী স্পেনিশ জেনারেল সেলিষ্টার ভেজা বেড়ালের মতো আবদুল করীমের সামনে দাঁড়িয়ে। এত বড় যুদ্ধশক্তির জেনারেল অথচ ভয়ে থর থর করে কাঁপছেন।
আবদুল করীম ভয়ংকর শীতল গলায় বললো,
আয়! সভ্য দুনিয়ার অসভ্য জেনারেল! আমি তোমাকে বলেছিলাম না, মারকেশ মুসলমানদের। মারাকেশ এ দেশের জনগণের! তোমাদের একদিন এই নোংরা দখলদারিত্ব ছেড়ে এখান থেকে চলে যেতে হবে। এমন ন্যায্য কথায়ও তোমার টনক নড়লো না। তুমি জঙ্গি শক্তির নেশায় বুঁদ হয়ে আমাকে জেলখানার অন্ধকার কুঠুরীতে ছুঁড়ে মেরেছো।
শোন! আবদুল করীম! জেনারেল সেলিষ্টার কিছুটা সামলে নিয়ে বললেন, তোমরা আমাদের জঙ্গিশক্তির মোকাবেলা করতে পারবে না। আমাদের যুদ্ধ শক্তির সামনে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারবে না। আমাকে মেরে ফেললেও তোমরা স্বাধীন হতে পারবে না। আমরা যে দেশে টুকি সে দেশ থেকে স্বাধীনতা নামক কাল্পনিক শব্দটি মুছে দিই। মারাকেশেও তা মুছে দিয়েছি। আমাকে মেরে কোন লাভ নেই। আর যদি মারোই তাহলে মনে রেখো, আমাকে হত্যার প্রতিশোধ মারাকেশের প্রতিটি মুসলমানের রক্ত ঝড়িয়ে নেয়া হবে। কারণ, তোমাদের কাছে আসলেই কোন অস্ত্র শক্তি নেই।
আমাদের শক্তি একমাত্র আল্লাহ এবং আমাদের তাজা ঈমান আব্দুল করীম দৃঢ় কণ্ঠে বললো, তোমাদের খোদা সত্য হলে তাকে বললো আমাদের হাত থেকে তোমাকে জীবিত উদ্ধার করে নিয়ে যেতে।
জেনারেল সেলিষ্টার প্রথমে কিছুক্ষণ হুমকি ধমকি দিলেন। তারপর সোনাদানা, নারী ও ক্ষমতার লোভ দেখালেন। বন্ধুত্ব ও সন্ধির প্রস্তাবও দিলেন এবং অবশেষে জীবিত রাখলে মারাকেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। এসবের উত্তরে আব্দুল করীম নির্বিকার রইলো। শুধু শীতল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। জেনারেল সেলিষ্টারের কথা শেষ হলে আবদুল করীমের মুক্তিযোদ্ধাদের বললো,
তোমরা প্রতিশোধ নাও। প্রতিশোেধ নাও মারাকেশের সেসব নিষ্পাপ মুসলমানদেরকে হত্যার, যাদেরকে এই নির্দয়-নিষ্ঠুর জেনারেলের হুকুমে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে।
***
যে জেনারেলের হাত, পা, দেহ অসংখ্য মারাকেশবাসীর রক্তাক্ত লাশ দেখে হায়েনার মতো উল্লাসে দুলে উঠেছে, সেই জেনারেলের দেহে একই সঙ্গে অনেকগুলো বর্শা, তলোয়ার ঢুকে পড়লো। জেনারেল সেলিষ্টার লুটিয়ে পড়লেন। একজন নির্মম নরখেকো ঘাতকের অপবিত্র দেহ থেকে তার প্রাণপাখিটি উড়ে গেলো।
ততক্ষণে রণাঙ্গন মুক্তিবাহিনীর হাতে চলে এসেছে। ক্যাম্পের চার দিকেই মুক্তিবাহিনীর প্রাধান্য। এর মধ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, স্পেনিশদের, জেনারেলকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ ধরবে স্পেনিশদের অবশিষ্ট মনোবলও ভেঙ্গে গেলো। পুরো ক্যাম্প ইতিমধ্যে রক্তের জোয়ারে ভেসে গেছে। পরাশক্তির অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ হলেও আজ এরা নিপীড়িত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে রক্তের বন্যায় ভেসে গেছে।
শত্রু সেনা এবার পালাতে শুরু করলো। কিছু সৈন্য পালাতে গিয়েও মারা পড়লো। এভাবে স্পেনিশদের অনেক সৈন্যই নিহত হলো। অক্ষত রইলো তারাই যারা নির্বিঘ্নে পালাতে পারলো। বিশাল এক অস্ত্রভাণ্ডার রেখেই ওরা পালালো।
মুক্তিসেনারা চলে যাওয়ার পর স্পেনিশ ক্যাম্পে লাশ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। স্পেনিশ সেনাবহিনীর হে কোয়ার্টারে এই সংবাদ পৌঁছার আগেই মুক্তিসেনারা তাদের গোপন ক্যাম্পে চলে গেলো।
এই গেরিলা অভিযান চালানো হয়েছিলো অস্ত্রের জন্য। সে প্রয়োজন পূর্ণ হয়ে গেছে আপাতত।
মারাকেশের স্পেনিশদের দখলকৃত প্রদেশসমূহের জায়গায় জায়গায় হোট বড় সেনা চৌকি ছিলো। আবদুল করীমের মুক্তিসেনারা রাতের বেলায় সেসব চৌকিকে চারদিক থেকে ঘিরে নিয়ে পিলে চমকে দেয়া সুরে এ ধরণের ঘোষণা দিতে,
অস্ত্র সমর্পণ করে আমাদের কাছে চলে এসো। আর না হয় এখান থেকে জীবিত বের হতে পারবে না।
এমন ঘোষণাও শোনা যেতো,
আজকের রাত্রে পর যদি জীবিত থাকতে চাও এবং এই রাতটিই সর্বশেষ রাত মনে করে না থাকে, তাহলে কাল সকালে যেন এখানে আর একটাকেও দেখা না যায়।
প্রতি রাতেই কোন না কোন সেনা চৌকির আশেপাশে এ ধরণের ঘোষণা শোনা যেতো। মরুর নিঃস্তব্ধ রাতে এমন আচমকা চিৎকার স্পেনিশদের কলজে কাঁপিয়ে দিতো। যেন এটা কোন অশরীরি অট্টহাসি।
এ ছাড়াও স্পেনিশ সেনাদলের এত বড় শক্তিশালী ক্যাম্পে মুক্তিসেনাদের অবিশ্বাস্য আক্রমণ ও জেনারেল সেলিষ্টারের মৃত্যু পুরো স্পেনিশ আর্মিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিলো।
এই আতঙ্ক ও রাতের বেলায় আচমকা গেরিলাদের ঘোষণার কারণে সক হতেই দেখা যেতো যে চৌকি খালি হয়ে গেছে। এভাবে অনেকগুলো সে। চৌকি খালি হয়ে গেলো। কিছু কিছু চৌকিতে মুক্তিসেনারা রাতে গেরিলা হাম চালিয়ে উন্ন প্রযুক্তির অনেক অস্ত্র হাতিয়ে নিলো।
***
আবদুর করীমের এবার মুক্তিসেনাদের নিয়মিত সেনাবাহিনীর মতো সুশূল বাহিনীর নিয়মতান্ত্রিকতায় অভিজ্ঞ করে তুললো। তারপর গুপ্ত ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যথারীতি সম্মুখ সমরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। এখন আবদুল করীম তার হেডকোয়ার্টার রীফ পাহাড় সারির গহীন অঞ্চলে সরিয়ে নিয়েছে। মুস্তিসেনারা এতদিনে স্পেনিশদের বেশ কিছু চৌকি ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চল দখল করে নিয়েছে।