সেই বীর জোয়ান আরো বললেন,
কর্নেল কিয়ানী শহীদের এক ভবিষ্যৎ সুসংবাদ দানের কথা আজ মনে পড়ছে। তিনি কুরআন অন্তপ্রাণ ছিলেন। প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি ফায়সালা পবিত্র কুরআনের আলোকে করতেন। তিনি সেদিন সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর জোয়ানদের এ সুসংবাদ দিলেন যে,
তোমরা যে পথ দিয়ে পাহাড়ে চড়বে সে পথের প্রতি স্কয়ার ফিট জায়গায় দুশমন মাইন পিন্ড পুঁতে রেখেছে। আমি তোমাদেরকে এ নিশ্চয়তা দিচ্ছি, চলার সময় তোমাদের কারোরই পায়ের নিচে বা বুটের তলায় একটিও ফিল্ড মাইন বিস্ফোরিত হবে না। পবিত্র কুরআন থেকে আমি এই সুনিশ্চিত ইংগিত পেয়েছি। আরেকটি সু-সংবাদ শুনে নাও, দুশমন অন্ধ হয়ে যাবে। তোমাদের এই স্বল্প সংখ্যক সেনা ওদের চোখে দশগুণ হয়ে ধরা দিবে।
হলোও তাই। জোয়নরা যখন রাতের গভীর অন্ধকারে নিঃশব্দে পাহাড় চড়ছিলো তখন তারা টেরও পেলো না বিধ্বংসী ফিল্ড মাইনের ওপর দিয়ে ওরা এগিয়ে যাচ্ছে। একজন জোয়ানও মাইন বিস্ফোরণে আহত হলো না। একটি মাইনও যদি বিস্ফোরিত হতো কোন জোয়ান কেবল আহত বা শহীদই হতো না। বরং সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটা হতো সেটাহলো মাইন বিস্ফোরণের বিকট শব্দে শত্রুপক্ষ সচকিত হয়ে উঠতো। তারপর তাদের গ্রেনেড আর মেশিনগানের গোলায় নিমিষেই খতম করে দিতো আযাদ কাশ্মীরের এই গুটি কয়েক মুক্তিযোদ্ধাকে।
এভাবে স্বাধীনতাকামী মুক্তি সেনারা শত্রুর একেবারে ঘাড়ের পেছনে গিয়ে পজিশন নিলো যমদূত হয়ে। তারপর যে লড়াই হলো সেটা প্রায় এক তরফা লাড়াই হলো। শিখ রেজিমেন্টের সৈন্যরা সামান্য প্রতিরোধেরও সময় পেলো না। হামলার আকস্মিকতায় শিখ সেনারা পালাতে শুরু করলো। যে মাইন ফিল্ড আযাদ কাশ্মীরের জোয়ানদের পায়ের তলায় অলৌকিকভাবে বিস্ফোরিত হয়নি সেগুলোই একের পর এক বিস্ফোরিত হয়ে শিখদের ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলতে লাগলো।
কর্নেল কিয়ানীর দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণীও সত্য বলে প্রমাণিত হলো। দুশমন অন্ধের মতো পালাতে লাগলো। আযাদ কাশ্মীরের জোয়ানরা এমন ভয় ডরহীন দুঃসাহস নিয়ে জানবাযী রেখে হামলা চালালো যে, দুশমনের অতি মজবুত শক্তিশালী বাংকারগুলো অল্প সময়েই দখল করে নিলো। অনেক শিখ অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করলো। কিন্তু যারাই লড়তে চাইলো বা প্রতিরোধের চেষ্টা করলো তাদের বুক বা মাখা বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো।
বাংকারগুলো থেকে শিখদের পালানোর পর দেখা গেলো, প্রতিটি বাংকারে একাধিক মেয়ে রয়েছে। সব কটাই সুন্দরী যুবতী। এরা জানালো, কমান্ডিং অফিসাররা জোরপূর্বক এদেরকে ভোগ করার জন্য নিয়ে এসেছে। এরা শিখ রেজিমেন্টের রক্ষিতা। পরে এদের সবাইকে সসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হলো। আযাদ কাশ্মীরের কোন জোয়ান তো দূরের কথা কোন অফিসারও এদের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি।
কর্নেল হক কিয়ানী তার দূরদর্শী রণকৌশলের আরেকটি অপার প্রদর্শনী দেখালেন। হামলার আগে যেখানে তিনি তার জোয়ানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটা পাহাড়ের এমন একটি প্রশস্ত কন্দর ছিলো যে, সব সময় সে জায়গাটা শত্রুপক্ষের আড়ালে পড়ে থাকতো। তাদের দৃষ্টিসীমায় সে স্থানটি ধরা পড়তো না।
ভাষন শেষ করার পর কর্নেল কিয়ানী জোয়ানদেরকে সারি বন্ধ করে খোলা জায়গায় নিয়ে গিয়ে এমন পথ দিয়ে নদী পার করলেন যেখান থেকে দুশমন তাদেরকে দেখতে পেতো। কিন্তু এই সারিটি নদীর পারে গিয়ে দুশমনের দৃষ্টি থেকে সরে পড়তে এবং লুকানো অবস্থায় নদী পার হয়ে আবার এপারে চলে আসতো, এরপর আবার সারিবদ্ধ হয়ে দুশমনের দৃষ্টিসীমা দিয়ে নদী পার হতো। আবার গা ঢাকা দিয়ে এপারে এসে পুনরায় ভোলা জায়গা দিয়ে নদী পার হতো। কর্নেল কিয়ানী এভাবে তার জোয়ানদেরকে কয়েকবার এপার ওপার করালেন। কিন্তু শত্রু বাহিনী ওপার থেকে দেখছিলো, আযাদ কাশ্মীরের জোয়ানদের সারির পথচলা যেন শেষই হচ্ছে না। এবং একের পর এক সেনা সারি নদী পার হচ্ছে। আর তাদের দৃষ্টিতে এ ছিলো পুরো ব্রিগেডের সৈন্য। আড়াই তিনশত জোয়ানকে কর্নেল এমন ভাবে নদী পার করালেন যে, তাদের দৃষ্টিতে তা আড়াই তিন হাজারে রূপান্তরিত হয়ে গেলো।
এই মুষ্টিমেয় জোয়ানরা যখন প্রায় দশ হাজার ফিট উচ্চতায় চক পাতা পাহাড়ে হামলা চালালো তখন তারা রক্ত মাংসের মাত্র আড়াই তিনশ জোয়ান ছিলো না। তারা হয়ে গেলো একেকজন উৎক্ষিপ্ত আগুনের গোলা। আর এই আগুন ছিলো কুরআন ও ঈমানের। হামলার মধ্যে এমন প্রচন্ডতা ছিলো যে, শত্রুপক্ষের এবিশ্বাস জন্মালো যে, এ কেবল একটি কোম্পানি না, বেশ কয়েকটি প্লাটুন তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তাদেরকেই তারা সন্ধায় নদী অতিক্রম করতে দেখছিলো।
জোয়ানদের মধ্যে ঈমানের জাগ্রত শক্তি তো ছিলোই আর ছিলো কর্নেল কিয়ানীর সংকল্পবদ্ধ গভীর ব্যক্তিত্বের প্রভাব। সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে এ অনুভূতিও ছিলো, কোন বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটলেও আল্লাহ তাআলা তাদের জেনারেল আব্দুল মজীদ সালিককে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনিও বসে থাকবেন না। কারণ, তিনিই নিজের প্রশাসনিক পদকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে এই বিপদজনক হামলার অনুমতি দিয়েছেন।
লড়াইয়ের একেবারে শেষ দিকে যখন শিখ রেজিমেন্টের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গেছে তখন কর্নেল কিয়ানি শহীদ হয়ে যান। তার বিভিন্ন পত্রাবলি থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এই শাহাদাত বরণের সুসংবাদ তিনি আগেই পেয়েছিলেন। এই লড়াইয়ের আগে তিনি তার মা, তার ছেলে ও তার ভাইকে চিঠি লিখেন। তার মাকে তিনি লিখেন,